স্মরণকালের ভয়াবহ বানে ডুবে আছে সিলেট অঞ্চল। পানির এমন রুদ্র রূপ দেখে বিস্মিত সবাই। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া এই প্লাবনে অন্তত অর্ধকোটি মানুষ পানিবন্দি। এ বন্যার জন্য একদিকে উজানে ভারতের আসাম-মেঘালয়ের টানা ভারি বৃষ্টি, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে লাগাতার বর্ষণকে দায়ী করা হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলে বন্যার এমন মহাদুর্যোগ হঠাৎ করে আসেনি। জুনের মাঝামাঝি বন্যা ফণা তুলবে- এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল এ মাসের শুরুতেই। তবে এই পূর্বাভাস পাত্তা দেয়নি কেউ।

জানা যায়, জুনের শুরুতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষকদের কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি বিরূপ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে একাধিক সেমিনারে নানা পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহযোগিতায় হওয়া এসব সেমিনারে দেওয়া হয়েছিল ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাসও। সমকালেও মধ্য জুনে বন্যার আশঙ্কা করে প্রকাশ করা হয়েছিল প্রতিবেদন। তবে গত মে মাসের সিলেটে বন্যার অভিজ্ঞতায় এখনকার প্লাবনের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষ ধারণা করতে পারেনি। ফলে বন্যার পূর্বাভাসকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা কেউই আমলে নেয়নি।

পাউবোর এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিস্থিতি আসলে ধারণার বাইরে চলে গেছে। এমন বন্যা সিলেটে কখনও হয়নি। তাই পূর্বাভাসকে সম্ভবত কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। এখন খেসারত দিতে হচ্ছে।

সিলেটে নদনদীর পানি গত বুধবার থেকে বাড়তে শুরু করলেও তা কেউ গা করেনি। বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে শহর তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সুনামগঞ্জ। তার আগেই সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা প্লাবিত হয়। শুক্রবার সকালের মধ্যে সিলেট জেলার ১০ লাখের বেশি মানুষ হয়ে পড়ে পানিবন্দি। একই দিন হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে। গতকাল শনিবার সিলেট অঞ্চলের ৪০ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত উল্লেখ করে বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা ডুবছে। বন্যায় গৃহবন্দি মানুষকে উদ্ধার এবং ত্রাণ কার্যক্রমের গতি বাড়ানো হচ্ছে।

সিলেট অঞ্চলে এক মাস আগের বন্যায় আউশ ধানের পর এবার আমনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৪৯ হেক্টর, সুনামগঞ্জে ১০ হাজার হেক্টর, মৌলভীবাজারে ৩০০ হেক্টর ও হবিগঞ্জে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর আউশ ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া সিলেট জেলায় ১ হাজার ৫৪৪ হেক্টর, সুনামগঞ্জে ২ হাজার ৪০০ হেক্টর এবং মৌলভীবাজারে ৫০ হেক্টর মৌসুমি সবজি বন্যার পানিতে ডুবে আছে। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পরপর দু'দফা বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জে বোরো ও আউশ ধানের পর এবার আমন তলিয়ে যাওয়াকে বড় ধরনের ক্ষতি হিসেবে দেখছেন সংশ্নিষ্টরা।

সিলেটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃষ্টি ও পাউবো বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। এ দুটি পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের করণীয় কী হবে, তা নিয়েই মূলত সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এসব সেমিনারে কৃষকদের আমনের বীজতলায় ধীরে বুনতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, এখন অ্যাপের মাধ্যমেও যে কেউ কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতে পারে। এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্পে পাউবো বন্যা ও আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস বিষয়ে সহযোগিতা করে। এবারের পূর্বাভাসকে মানুষ সেভাবে আমলে নেয়নি বলে দ্রুতগতিতে পানি চলে আসায় শেষ পর্যায়ে কেউ বেরোতে পারেনি। বসতভিটা তলিয়ে গেলেও নৌকা বা যোগাযোগের অভাবে মানুষ ঠাঁই নিতে পারেনি নিরাপদ আশ্রয়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত করা হয়েছে।

সিলেট পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, সিলেটে ভয়াবহ বন্যার মূল কারণ উজানে ভারি বৃষ্টি। উজানে গত তিন দিনে ২ হাজার ৪৬১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যেখানে গত মাসের বন্যার সময় এক সপ্তাহে বৃষ্টি হয়েছিল ২ হাজার ২০০ মিলিমিটারের মতো। এতেই অনুমান করা যাচ্ছে, এবারের বৃষ্টিপাতের ভয়াবহতা। এবার সিলেট অঞ্চলেও স্থানীয়ভাবে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষ সাধারণত নিজের বসতভিটা ছাড়তে চায় না। এবার যে গতিতে পানি ঢুকেছে, মানুষকে নড়ারও সুযোগ দেয়নি।

সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, আরও দু'দিন সিলেটে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। উজানেও এ সময়ে ব্যাপক বৃষ্টি হবে। তারপর আশা করি বৃষ্টি কমবে। এতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, জুনের শুরুতে সিলেট অঞ্চলের একাধিক সেমিনারে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বন্যার কথা বলা হয়েছিল।