- সারাদেশ
- বছর বছর গাফিলতি বয়ে এনেছে ক্ষতি
বছর বছর গাফিলতি বয়ে এনেছে ক্ষতি
-samakal-62ae478aa3b93.jpg)
বন্যায় নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে মানুষ - সমকাল
কাসমির রেজা। ছেলেবেলা থেকেই হাওরের জলরাশিতে চোখ রেখে তাঁর বেড়ে ওঠা। বেসরকারি একটি কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে সিলেট নগরে থাকলেও মাটির টানে ঘুরে বেড়ান হাওরের বাঁকে বাঁকে। হাওরকে ভালোবেসে এলাকার যুবসমাজকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন 'পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা' নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গতকাল শনিবার বিকেলে ফোনে যখন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কাসমির রেজার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁর কণ্ঠ কেমন যেন অচেনা ঠেকল। সিলেট অঞ্চলের এমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখে প্রাণচঞ্চল এই তরুণও বিচলিত। বলছিলেন, এবারের মতো সর্বনাশা পানি আগে কখনও দেখিনি।
কী কারণে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো- সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কাসমির রেজা বলেন, এমন বিপর্যয় হঠাৎ করে হয়নি। প্রতিবছরই হাওর ডোবে; কৃষকের কান্না শোনে না কেউ। এবার ডুবল শহরও। বাঁধ নির্মাণকাজে দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে কান্না থামবে না। তাঁর মতে, এমন দুর্যোগ অনেকটা মানবসৃষ্ট। নদী গিলে খাচ্ছে দখলদাররা। বানের পানি এখন আর নামার সুযোগ নেই। বছরের পর বছর গাফিলতি সিলেট অঞ্চলের মানুষের জন্য বয়ে এনেছে ক্ষতি।
বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও অনেক কারণ দেখছেন গবেষকরাও। তাঁদের ভাষ্য, নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। এসব বন্ধ না হলে সামনে আরও বড় বিপদের শঙ্কা তাঁদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে বন্যা বেড়ে যাওয়ার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, আস্তে আস্তে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বন্যা আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এ অবস্থায় নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। পূর্বাভাস অনুযায়ী আগে থেকেই নিতে হবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
প্রকৃতির হেঁয়ালি আচরণ: সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) আকুতি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে। তিনি পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের জন্য নৌকা চাইছেন; পাচ্ছেন না। তিনি লিখেছেন, 'কোথাও ট্রলার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উজান এলাকা থেকে একটা ট্রলার-নৌকা কেউ ম্যানেজ করতে পারলে অতিসত্বর যোগাযোগ করুন।' ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার নামার জায়গার খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে লিখেছেন একজন। ২৪ ঘণ্টায়ও মেলেনি একটু খালি জায়গার খোঁজ। পানিতে ভাসছে পুরো জনপদ। সুনামগঞ্জ শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়ির ভেতর পানি কোমরসমান।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে অতিবৃষ্টির কারণে এবারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, তিন দিন চেরাপুঞ্জিতে ২৪৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এখনও ঝরছে বৃষ্টি। এ রকম টানা বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে একবার, তিন দিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার; আর ১৯৭৪ সালে হয়েছিল ২৭৬০ মিলিমিটার।
সুনামগঞ্জ সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকা শুরু। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে মেশে। ভৈরব কিংবা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। অতীতের বৃষ্টি বেশি হলেও নদী গতিশীল ছিল। এখন নদীতে পানির প্রবাহ নেই বলে মনে করেন গবেষকরা। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বৃষ্টির ধরন বদলেছে। এখন অনেক ভারি বৃষ্টি হয়। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে তা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা তৈরি করছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, চেরাপুঞ্জিতে আরও দু-তিন দিন বৃষ্টি হলে এই বন্যা মহাবিপদ ডেকে আনবে।
মানবসৃষ্ট কারণেও ধুঁকছে সিলেট: চেরাপুঞ্জির রেকর্ড বৃষ্টি কি বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র কারণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদনদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির পানি নদীপথে হাওর থেকে বেরিয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারাটা প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ জন্য তাঁরা নদীর নাব্য কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
সিলেটের স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে গতকাল সমকালের কথা হয়। তাঁরা জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জ দুই শহরেই সুরমা নদী ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে ভাগাড়। সিলেট নগরীর কালীঘাট থেকে টুকের বাজার, কালীঘাট থেকে দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকা পর্যন্ত সর্বত্রই আবর্জনার স্তূপ। একইভাবে সুনামগঞ্জ শহর এলাকায় সুরমা নদীর তীরও বর্জ্যে ভরা। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সাহেববাড়ি সেলুঘাট, উত্তর আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, চাঁদনীঘাট, সুরমা হকার্স মার্কেট, জগন্নাথবাড়ি, প্রধান মাছবাজার এলাকা, জেলরোড ফেরিঘাট এলাকা, লঞ্চঘাট এলাকা, উকিলপাড়া এলাকা, ষোলঘর এলাকায় নদীতীরে স্থানীয় লোকজন নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁর পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা রকমের বর্জ্য ফেলছেন। ফলে নদী হারিয়ে ফেলছে তার নাব্য।
দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন আবদুল হাই আল হাদি। তিনি জানান, ভবিষ্যতে বন্যা থেকে মুক্তি পেতে সিলেটের সব নদনদী খনন জরুরি। এ ছাড়া নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার। তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে নদীগুলো ক্রমে সংকোচন ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নদীশাসনের নামে নদীবিধ্বংসী কর্মকা। যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। এতে এবার অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি জমে বন্যার সৃষ্টি করেছে।
নদীগবেষক মুমিনুল হক সরকার বলেন, প্রতিবছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি এলে সেটা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওর এলাকার বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওর বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, প্রথম দফা বন্যার পর দ্বিতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা নানাভাবে প্রকাশ করা হলেও সে বন্যা মোকাবিলায় সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। অথচ মানুষকে সতর্ক করা উচিত ছিল। দায়িত্বশীল মহল থেকে মানুষকে সতর্ক করা হলে এখন সিলেটের মানুষকে এমন দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না।
মন্তব্য করুন