স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রায় পুরো এলাকা। পানিবন্দি মানুষের উদ্ধার কার্যক্রম নৌযানের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নৌকা মিললেও চাওয়া হচ্ছে ৮-১০ গুণ ভাড়া। কিলোমিটারপ্রতি চার-পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া চাইছেন নৌকার মালিকরা। ফলে গরিব অসহায় মানুষ আরও নিরুপায় হয়ে পড়েছে। বেড়েছে সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশার ভাড়াও। রেইনকোট পাঁচ গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

গতকাল শনিবার বিকেলে নগরীর দর্জিবন্দের বাসিন্দা কামাল আহমদ সমকালকে বলেন, সকাল থেকে একটা নৌকা ভাড়া করার চেষ্টা করছি। বিশ্বনাথের কামালবাজার মাধবপুর গ্রামে আমার আত্মীয়স্বজন বন্যায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে তাঁরা খুব সমস্যায় রয়েছে। তাঁদের আনার জন্য সারাদিন ধরে নৌকা ভাড়ার চেষ্টা করেও পাচ্ছি না। শুক্রবার রাতে মোশারফ হোসেন নামে কানাডাপ্রবাসী এক ব্যক্তি সমকালের সিলেট প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নৌকার জন্য সহযোগিতা চান। তিনি জানান, হবিগঞ্জের কিছু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে তাঁরা উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে অনেক চেষ্টা করেও দেশে তাঁর লোকজন কোনো নৌকা ভাড়া করতে পারছেন না। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আব্দুল মুকিত নামে এক ব্যক্তি সমকালকে জানান, পুরো বাড়ি তলিয়ে গেছে। তাই সবাইকে নিয়ে সিলেট নগরীতে আত্মীয়ের বাসায় চলে আসতে চাইছেন। কিন্তু কোনো নৌকা পাচ্ছেন না।

শুক্র ও শনিবার সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের সালুটিকর বাজারে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষকে নৌকায় করে আসতে দেখা যায়। সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শত শত মানুষ নৌকা করে সালুটিকর বাজারে আশ্রয় নেয়। এখানে শতাধিক যাত্রীবাহী নৌকা ছাড়াও বালুবাহী নৌকাও বন্যাদুর্গতদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। কিন্তু মাঝিরা ভাড়া চাইছেন ১০-১২ গুণ।

কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ থেকে আসা রহিম মিয়া সমকালকে জানান, তাঁদের এলাকায় বসতঘরের চাল ছুঁইছুঁই পানি। তাই নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করতে এসেছেন। গোয়াইনঘাট থেকে আসা আকলিমা সমকালকে বলেন, নৌকা ভাড়ার কোনো লাগাম নেই। একটা নৌকার ভাড়া ২-৩ হাজার টাকা বলছে। গরিব মানুষ। তারপরও ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বাঁচার জন্য এসেছি।

ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়া সাংবাদিক মোহাম্মদ তারেকের সঙ্গে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কথা হয়। তিনি জানান, শনিবার সিলেটের গোবিন্দগঞ্জ এলাকা থেকে সুনামগঞ্জের দিকে দেড় কিলোমিটারের পথের জন্য নৌকা ভাড়া দিয়েছেন সাড়ে চার হাজার টাকা। তিনি জানান, কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ রুটের নৌকা ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তারেক বলেন, এই রুটে ১০ কিলোমিটার পথের নৌকা ভাড়া ৪ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, নৌকা ভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়াও। শনিবার একটি সিএনজি অটোরিকশাতে দুই ঘণ্টার জন্য তাঁকে দিতে হয়েছে ১২শ টাকা। তিনি আরও জানান, সিলেটের স্টেডিয়াম মার্কেটে ৮০০-১০০০ টাকার রেইন কোট সাড়ে চার হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।

সিলেট ব্যুরো জানায়, যে পথে প্রতিজনের নৌকা ভাড়া ছিল ৩০-৪০ টাকা, সেখানে চাওয়া হচ্ছে হাজার টাকার ওপরে। রিকশা-সিএনজি অটোরিকশাও মিলছে না তেমন। অল্পসংখ্যক সিএনজি অটোরিকশা চললেও ভাড়া চাওয়া হচ্ছে কয়েক গুণ।

বন্যাকবলিতদের উদ্ধার এবং ত্রাণ বিতরণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জলযানের অভাবে। বন্যায় আটকেপড়াদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সিলেট শহর থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অনেকেই গ্রামে যেতে চাইলে নৌকা ভাড়া বেশি হওয়ায় যেতে পারছেন না। সালুটিকর বাজার থেকে এমন একাধিক টিমকে গতকাল শনিবার ফিরে আসতে দেখা যায়। সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল জানান, তাঁরা কয়েক বন্ধু মিলে কিছু শুকনো খাবার আর চাল জোগাড় করেছিলেন পানিবন্দি মানুষকে দিতে। ঘাটে এসে দেখেন, নৌকা ভাড়া চাওয়া হচ্ছে কয়েক গুণ, যা দিয়ে তাঁদের পক্ষে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো সম্ভব না, তাই ফেরত যেতে হয়েছে। ঢাকা থেকে ত্রাণ দিতে যাওয়া লায়নস ক্লাবের একজন প্রতিনিধি সমকালকে জানান, ত্রাণ বিতরণের জন্য তাঁদের ট্রলার ভাড়া ২০ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে।