সিলেটের পর ভয়াবহ বন্যার কড়া নাড়ছে উত্তরাঞ্চলে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে শনিবার ৭২ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী আবার কোথাও কোথাও অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।

তাই উজানের ঢলে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলাসহ নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে যেকোনো সময় ভয়াবহ বন্যার রুপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে রংপুর বিভাগের অধিকাংশ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কিছু নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে।

বন্যাদুর্গতরা পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। পানির তোড়ে অনেকের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে ফসলি জমি, ঘরবাড়িহারা হচ্ছে নদীর তীরবর্তী মানুষ। এক নিমিষেই দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন তারা।

গৃহছাড়া, আশ্রয়হীনদের আর্তনাদ-আহাজারিসহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসছে উত্তরাঞ্চলে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রংপুর বিভাগে বন্যাকবলিতদের চাল, শুকনা খাবার, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করেছে প্রশাসন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে দুর্গতের জন্য।

তিস্তায় পানি থৈ থৈ করছে। ছবিটি রোববার দুপুরে গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নে শেখ হাসিনা সেতু এলাকা থেকে তোলা।

নজিরবিহীন বন্যা হলে জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। এদিকে বন্যার হাত থেকে নদীর তীরবর্তী, চর ও দ্বীপচরের মানুষদের রক্ষায় দুর্বল বাঁধ মেরামত, ভাঙনরোধে পর্যাপ্ত জিওব্যাগ মজুত রেখেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্থানীয়দের আক্ষেপ সহায়তা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ত্রাণ আর জিও ব্যাগের ব্যবহার নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদী শাসনই একমাত্র চাওয়া তাদের।

রংপুর বিভাগের নদ-নদীর অবস্থা

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, রোববার বিকেল ৩টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। রংপুরের বদরগঞ্জ পয়েন্টে যমুনেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ৩৫ মিটার এবং নগরীর ইসলামপুরে ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলায় ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং করতোয়া নদীর পানি চকরহিমপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৪৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এদিকে কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার, তালুক শিমুলবাড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদীর পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বেশির ভাগ নদীর পানি বৃদ্ধির সূচক উর্ধ্বমুখী রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলের প্রায় সব নদী নাব্য হারিয়েছে। উজানের পাহাড়ি ঢলে পলি পড়ে ভরাট হয়েছে নদীগুলো। ফলে পাহাড়ি ঢল নামলে পানি ধরে রাখতে পারে না নদী। পানি ডুবিয়ে দেয় রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, গ্রামীণ জনপদ। এক সপ্তাহ ধরে পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। এতে করে রংপুর বিভাগের ৩২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রামের নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ওঠা-নামা করছে। এতে করে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরের সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

রোববার দেখা যায়, পানিতে থৈ থৈ করছে তিস্তা। নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় চরের কিছু মানুষ টানা জাল দিয়ে মাছ শিকারে নেমে পড়েছেন। পানির ওঠা-নামায় নদীর তীরবর্তী কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই নদীর বুকে নৌকায় করে বাড়ি ভেঙে আনার দৃশ্যেরও দেখা মিলেছে। নৌকায় করে গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরশংকরদহে গেলে দেখা মিলে থৈ থৈ পানির মাঝে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে ঘরবাড়ি-গাছপালা।

বন্যার কবলে পড়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অধিবাসীরা। নৌকার দেখা মিলতেই ত্রাণের প্রত্যাশায় একবুক পানি মাড়িয়ে, ভেলায় করে ছুটে আসেন ত্রাণপ্রত্যাশীরা। প্রায় বিলীনের পথে শংকরদহ গ্রামে আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। তাই টিনের চাল, বাঁশের বেড়া, চুলা, গবাদিপশু নৌকায় করে মহিপুর শেখ হাসিনা ব্রিজের আশপাশে উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন অধিবাসীরা।

তিস্তা নদীর ভাঙনের কারণে রোববার নৌকায় করে বাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন দুলু চৌকিদার।

এক সপ্তাহে ওই গ্রামের দুলু চৌকিদার, সুলতান মেম্বার, মশিয়ার, ওলি সর্দার, আমিনুল, নুরুল, পেয়ারুল, নুর ইসলামসহ প্রায় ২০টি পরিবার ভাঙনের কারণে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন। রোববার বাড়ি সরিয়েছেন দুলু চৌকিদার ও সুলতান মেম্বার।

দুলু চৌকিদারের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, ‘নদী বাড়ির কাছোত চলি আসছে। দুই লাখ টাকা দিয়ে ৩ দোন জমি বন্ধক নিছনু। ভুট্টা, ধান হইছিল। এল্যা সব নদীত। বাড়ি ভিটা কোনও বাঁচিল না। টিনের চালা, বকরি, বাসন, ঘরের পইগুলো নিয়ে ব্রিজের মোকাত উঁচা জায়গায় ঘরকোনা নিয়া রাখমো। এ্যালা টাকাও নাই যে উঁচু জায়গায় কিনি বাড়ি করি থাকমো। নদীর ভাঙন একেবারে হামাক নিঃস্ব করি ফেলাইল।’

সুলতান মেম্বারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘নদীত ঘরবাড়ি চলি গেইতোছে। সকাল থাকি না খ্যায় আছোং, হামাক কায়ে ত্রাণ দেয় না। মিডিয়াত কতা কয়া কী হইবে? সরকার তো হামার এত্তি বান্ধ (বাঁধ) দিবার ন্যায়। পারেন তো একটা বান্ধ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তারপর হামার গোরোত আসি হামার কতা নেন। হামার ঘরবাড়ি পানিত যাইতোছে, আর তোমরা সেই ছবি তুলি টিপিত দেখায়া চেয়ারম্যানের ঘরোক মোটাতাজা করতোছেন।’

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, ‘তিস্তা নদীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমার এলাকা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিনবিনার চর থেকে মহিপুর শেখ হাসিনা সেতু পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার বাঁধ দাবি করে আসছি। এই বাঁধ হলে আমাদের কৃষি জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ রক্ষা পাবে। অথচ সরকার দেশে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তিস্তা নদীর বামতীরে মাত্র ৬ কিলোমিটার বাঁধ দিচ্ছে না।’

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদ উদ্দিন বলেন, আমার উপজেলায় ৭০০ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। আমরা তাদের চাল, শুকনা খাবার, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেছি। তাদের যে কোনো প্রয়োজন জানালে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণের কোনো সংকট নেই। জনপ্রতিনিধিরা চাহিদা দিলেই আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যহত রেখেছে প্রশাসন। রংপুর বিভাগীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কুড়িগ্রামে ২ শ গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য ২৯৫ টন চাল, সাড়ে ১৪ লাখ নগদ টাকা, শিশুখাদ্যের জন্য ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, গো-খাদ্যের জন্য ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং ২ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ করা হয়েছে। লালমনিরহাটের ৪টি উপজেলার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য ১৫০ টন চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বুকসমান পানি মাড়িয়ে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন বানভাসি নারী। রোববারের ছবি।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষের জন্য ৫ মেট্রিক টন চাল ও শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার দেড় শ পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। তাদের জন্য ৩ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াহাব ভূঞা বলেন, ভয়াবহ বন্যা হলে বন্যার্তদের উদ্ধার, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার প্রস্তুতি এবং ত্রাণ বিতরণের জন্য চাল, শুকনা খাবার, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আমি নিজেই ওই জেলা পরিদর্শনসহ ত্রাণ নিয়ে গিয়েছি। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছে। আশাকরছি আমরা বন্যা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারব।        

যা বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড

বন্যা মোকাবেলায় নানা প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পক্ষ থেকে। পানিসম্পদমন্ত্রী ও মহাপরিচালকের নির্দেশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্বল বাঁধ মেরামত, ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা, স্পার সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন।

ঘর ভেঙে নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। ছবিটি রোববার দুপুরে লক্ষ্মীটারী র চরশংকরদহ এলাকা থেকে তোলা।

পাউবো’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পশ্চিমাঞ্চল) জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ সমকালকে বলেন, শনিবার আমি তিস্তার পুরো এলাকা ঘুরে দেখেছি। বন্যা-ভাঙন বাড়লে ঘরবাড়ি-জনপদ রক্ষায় আমরা নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। দুর্বল বাঁধ, স্পার মেরামতে প্রত্যেক জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভাঙন রোধে পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে। আকস্মিক বন্যায় যেন মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেলক্ষ্যে জরুরি কাজের প্রত্যেক জেলায় পাউবো’র জনবল প্রস্তুত রয়েছে।

‘এছাড়া কুড়িগ্রামে নদী শাসনে ২২ কোটি ও গাইবান্ধায় ১৫ শ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। রংপুর ও লালমনিরহাটে নদী শাসনের জন্য একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র পুরো নদী একসঙ্গে একই সময়ে কাজ করা পাউবোর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভঙ্গুর এলাকা চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। যেখানে প্রকল্প তৈরি হয়নি, সেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। ২ বছরের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের সব নদী শাসনের আওতায় আসবে।’ যোগ করেন তিনি।