
'মাইনসে দিলে খাই, না দিলে রোজা রাহি। আমার বয়স হয়েছে, মরলেও সমস্যা নাই। কিন্তু নাতিডাইনতের (নাতি) লাইগ্যা কষ্ট হয়'- চোখ মুছতে মুছতে বুধবার কথাগুলো বলছিলেন নাসিরনগরের মেঘনা-তীরবর্তী কদমতলী গ্রামের বৃদ্ধা আক্কুল নেছা। জানিয়েছেন, চারদিন ধরে তাঁদের ঘরে খাবার নেই-সমকাল
নাসিরনগর উপজেলায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বন্যা পরিস্থিতি। প্রতিদিনই পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গরুর খামার, পুকুরের মাছসহ প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৩টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উজানের ঢল আর ভারি বৃষ্টির কারণে উপজেলার বেশিরভাগ স্থানেই এখন পানি। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছেন বানভাসি মানুষ। বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাটবাজার, রাস্তাঘাটে কোথাও হাঁটুসমান আবার কোথাও বুকসমান পানি। হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নাসিরনগরের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে ধারণা তাঁদের।
উপজেলার বুড়িশ্বর, গোয়ালনগর, ভলাকুট, কুন্ডা, ধরমন্ডল, চাতলপাড় ও সদর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পাকা-কাঁচা সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। লোডশেডিংয়ে ভোগান্তিও বেড়েছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার হাওরবেষ্টিত গোয়ালনগর, ভলাকুট ও চাতলপাড় ইউনিয়নে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। সর্বত্রই পানি আর পানি।
'চুলাত আগুন নাই, ঘরে খাওন নাই। বাড়িত দশটা-বারডা আবুইদ্দা (শিশু-কিশোর) লইয়া বিপদের মধ্যে আছি। কুডুম বাড়িত থেইক্যা খাওয়াইয়া আনছি। চাইর দিন ধইরা ঘরে খাওন নাই। গাওয়ের (গ্রামের) মেম্বার-চেয়ারম্যান আমরার খোঁজ খবর নেয় না। কেমনে পানির মধ্যে ঘরে থাহি! কী খাই, কী করি খবর লইছে না। গরিবের মরণ ছাড়া উপায় নাই।' চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন চাতলপাড় ইউনিয়নের মেঘনা-তীরবর্তী কদমতলী গ্রামের ৮০ বছরের আক্কুল নেছা।
তার মতো এমন অনেকেই বন্যার কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
৭০ বছর বয়সী বিপলা বেগম বলেন, 'আমার বড় পোলাডা গত কয়েক মাস আগে বাউনবাইরা থাইক্যা রিকশা চালাইয়া কিছু টেহা রোজগার কইরা দুই শতক জায়গা কিনছিন। সে জায়গায় একটা ঘরও করছিন। কিন্তু এহন বানের পানিতে ঘরডাও পানির নিচে। পাশের বাড়ির এক লোকের বাড়িত উঠছিলাম, সেই বাড়িতে এহন পানি।'
বুড়িশ্বর ইউনিয়নের আশুরাইল গ্রামের মাছচাষি জিয়া চৌধুরী বলেন, 'বিদেশ থেকে এসে ১৫টি পুকুর লিজ নিয়ে মাছচাষ করেছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে।'
ফান্দাউক ইউনিয়নের ধানচাষি ফারুক বলেন, 'আমি এ বছর ১০ বিঘা বোনা আমন চাষ করেছিলাম। এখন সব পানির নিচে।'
গরু খামারি চপল দেব বলেন, 'চারটি গরু মোটাতাজা করে ঈদে বাজারে বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছিলাম আমি। কিন্তু বন্যার কারণে গরুর দাম এখন কম।'
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ১৩টি কেন্দ্রে ১৬৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিন টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে পানি ঢুকেছে।
কৃষি কর্মকর্তা আবু সাইদ তারেক বলেন, ৯ হাজার হেক্টর বোনা আমন, ৩০ হেক্টর রোপা আমন, ২৫ হেক্টর সবজি ও ৩০ হেক্টর পাট তলিয়ে গেছে। ৩২ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিক বলেন, ৮০০ গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব খামারির জন্য ৫০০ কেজি গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অভিজিৎ রায় বলেন, ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জরুরি মেডিকেল টিম বিভিন্ন ইউনিয়নে গিয়ে ৬ হাজার মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছে। বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার প্যাকেট স্যালাইন ও ওষুধ।
ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) মো. মানাব্বের হোসেন বলেন, উপজেলায় পানি বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত উপজেলার প্রায় ৩ হাজার পরিবারের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে ৩৩ টন চাল ও ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন তাঁরা।
মন্তব্য করুন