- সারাদেশ
- শাক দিয়ে যে আর মাছ ঢাকা যাচ্ছে না
শাক দিয়ে যে আর মাছ ঢাকা যাচ্ছে না

'এভরিবডি', 'সামবডি', 'অ্যানিবডি' আর 'নোবডি'- পরিচিত গল্পটি এই চার বন্ধুকে নিয়েই। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। 'এভরিবডি' নিশ্চিত ছিল যে, 'সামবডি' তা করে দেবে। 'অ্যানিবডি' অন্তত তা করতে পারবে। দেখা গেল 'নোবডি' তা করেনি। এরপর 'সামবডি' তো মহাক্ষুব্ধ, কারণ কাজটি ছিল 'এভরিবডি'র। এভরিবডি ভেবেছিল, অ্যানিবডি তো পারত কাজটি করতে। কিন্তু নোবডি এটা বুঝতে পারেনি যে, এভরিবডির দায়িত্ব হলে তারা আদতে কেউই সেটাকে নিজের দায়িত্ব মনে করেনি। এভাবেই একে অন্যের ওপর দোষারোপ করে কাজটি অসম্পূর্ণই থেকে গেল।
বাংলাদেশ টেস্ট দলের বর্তমান অবস্থা এই চার 'বডি'র মতোই! এ ভাবছে সে করবে, সে ভাবছে ও করবে- এরকম করে দায়িত্বটা আসলে কেউই নিচ্ছে না। কখনও পিচ কন্ডিশন, কখনও ব্যাটার, কখনও বা বোলার- এসব শাকপাতা দিয়েই চলছে মাছ ঢাকা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন, একসময় মাছের কাঁটা যেন ঠিকই বেরিয়ে এসেছে। সত্য এটাই যে, এ দলটি টেস্টে পারছে না। আর কেউ না হোক, অধিনায়ক সাকিব অন্তত নিষ্ঠুর সত্যটি প্রকাশ করেছেন- 'আমাদের দলে কোয়ালিটি ব্যাটার নেই।'
কোচ রাসেল ডমিঙ্গোরও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে- 'আমাদের (বাংলাদেশের) টেস্ট সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি।' যদিও বিসিবিপ্রধান আবারও শাক টেনে নিয়ে এসেছেন এই বলে যে- 'সংস্কৃতি গড়তে সময় লাগবে। ভারতের প্রায় ২৬ বছর লেগেছিল প্রথম টেস্ট জিততে, এত অস্থির হলে হবে না। নিউজিল্যান্ড বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও আটটির মধ্যে মাত্র দুটিতে জিতেছে। তার মানে কি নিউজিল্যান্ড খারাপ?'- এ একটি ব্যাপার, অন্যকে খাটো করে দম্ভের সুষুপ্তি আমাদের ভীষণভাবে তাড়িত করে। নিজের গি তে বড় বেশি মাত্রায় সীমায়িত আমরা। যার অনেকটাই স্বেচ্ছাকৃত। আর এটা করতে করতেই নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনাগুলোর পরিসরগুলো ছোট হয়ে আসে। আত্মতৃপ্তিতে স্থূলতার প্রবেশ ঘটে তখনই। যে দলটি এ বছর মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জয়ের পর সাতটি ইনিংসে ৬০ রানের নিচে দলের ৫ উইকেট খুইয়ে বসে, যে দলের ব্যাটারদের মধ্যে নূ্যনতম ধৈর্যের পরিচয় দেখা যায়নি, সেই দলের সর্বাঙ্গে যে ব্যথা সেটা তো আর অস্বীকার করার নেই। একটা দেয়ালের নোনা ধরা জায়গাটি ঠিক করতে গিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট শুধু সেই জায়গাটিতে প্লাস্টার আর রং করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখন বোধহয় সময় এসেছে পুরো দেয়ালটি ভেঙেই নতুন করে সংস্কার করার।
যে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে খোদ নির্বাচকরাই অনাস্থায় থাকেন, বিকেএসপিতে সেঞ্চুরি করলেও যারা নূ্যনতম মূল্যমান দিতে চান না- তাঁদেরই কিনা ব্যাটার বাছতে হচ্ছে ঘরোয়া লিগের পারফরম্যান্স দেখে। এটা ঠিক যে, সব দেশে ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স বিচার করেই ক্রিকেটার জাতীয় দলে নির্বাচন করতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কতটুকু। ক্রিকেটাররা যে বিভাগ বা দলের হয়ে খেলে থাকেন, তাতে কতটুকু আবেগ বা দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে তাঁর? এমনও অভিযোগ আছে, নিজে সেঞ্চুরি বা ডাবল সেঞ্চুরি করার জন্য জয়ের সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে ড্র করা হয় ম্যাচটি। আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়েই কানাঘুষা থাকে, কোনো বোলার দুই ওভার বল করেই চেনা আম্পায়ারকে বলে ড্রেসিংরুমে গিয়ে অযথাই সময় কাটিয়ে আসেন! এই সংস্কৃতি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলে ঢোকার আগেই বিপিএল-ঢাকা লিগ খেলে কোটিপতি বনে যান। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারপর জাতীয় দলে না খেললেও বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে খুব একটা সমস্যা হয় না। এমনও কিছু ক্রিকেটার আছেন, যাঁরা এখন জাতীয় দলের আশা ছেড়ে দিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চিন্তা করছেন।
খেলোয়াড়দের মধ্যে ওই তাড়না বাড়ানো না গেলে এমনই হবে- আজ ওঁকে বাদ দিয়ে তাঁকে, কাল তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে দলে নেওয়া হবে। নির্বাচকদেরও একটা সংস্কৃতি ভাঙার সময় এসেছে। শুধু রানের পরিসংখ্যান কিংবা মিডিয়ায় আসা কোনো নামের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে খুঁজতে হবে সত্যিকারের 'টেকনিক্যাল সাউন্ড' সেই ছেলেটিকে, যে হয়তো এখনও কোনো জাতীয় লিগ খেলেনি, কিংবা খেললেও সেভাবে রান করতে পারেনি। সারাদেশে বিসিবির স্থানীয় কোচ ছড়িয়ে আছেন প্রায় একশর মতো। তাঁদের কাছ থেকে যদি দু'জন করেও ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে চলা প্রতিভাবান ব্যাটারের নাম আসে, সেখান থেকেও কোনো ক্যাম্পের মাধ্যমে কিছু নাম হয়তো পেয়েও যেতে পারেন। এ জন্য নির্বাচকদের ঢাকার বাইরে ছুটতে হবে। সমস্যা অবশ্য এখানেও, দেশের সব বিভাগ কিংবা জেলায় যে নিয়মিত লিগই হয় না। তার পরও এই সমস্যা মেনে নিয়েও যতটুকু সম্ভব কাঁচা হীরা দরকার। সমস্যা চিহ্নিত, দ্রুত রোগ সারানোর ব্যবস্থা করতে হবে বিসিবিকেই। কারণ, এ সংস্থাটিই যে দেশের ক্রিকেটের- 'এভরিবডি', 'সামবডি', 'অ্যানিবডি'। 'নোবডি'- হলে তাদের চলবে না।
মন্তব্য করুন