- সারাদেশ
- কেমন আছেন- প্রশ্নটা তাঁদের কাছে তেতো
কেমন আছেন- প্রশ্নটা তাঁদের কাছে তেতো
সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় এখনও অনেকে ভর্তি আছেন হাসপাতালে। চমেকের চক্ষু বিভাগেই আছেন ছয়জন। তাঁদেরই একজন আরিফ হোসেন। তাঁর দুই চোখই নষ্ট হওয়ার পথে -সমকাল
২০ নম্বর চক্ষু ওয়ার্ড। ৫০ পেরোনো হযরত আলী শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। চোখে কালো চশমা। বাঁ হাতের নিচে বালিশ, ডান হাতের একটা অংশ গামছায় মোড়া। সাংবাদিক শুনে ঘাড় ঘোরালেন। কেমন আছেন? এমন প্রশ্নে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন হযরত। উত্তর না দিয়ে হাতের গামছাটা আলতো সরালেন। বললেন, 'সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর দুর্ঘটনায় আমার ডান হাত কেটে ফেলা হয়েছে। চোখের অবস্থাও যায় যায়।' এ কথা বলতে বলতেই হযরত আলীর চোখের জলে স্যাঁতসেঁতে বালিশ।
শুধু হযরতই নন; বিএম ডিপোর আগুন বিস্ম্ফোরণে জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে জাহাঙ্গীর, মোসাদ্দেক, সালাউদ্দিন, আরিফ হোসেনদের। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গত মঙ্গলবার গিয়ে কষ্ট আর যন্ত্রণার খণ্ড খণ্ড ছবি চোখে ধরা পড়ে। এঁদের কেউ হাত হারিয়ে, কেউ পা হারিয়ে, কেউ বা চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনও চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, 'বিস্ম্ফোরণের এত দিন পরও আহত অনেকে শারীরিক নানা সমস্যা নিয়ে ধুঁকছেন। দগ্ধ শরীরে এখনও ক্ষত আছে কারও কারও। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকের চোখের কর্নিয়া। কারও কারও হাত ও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আমরা সবাইকে সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।'
ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক ও চক্ষুু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক চমেক হাসপাতালে এসে রোগীদের দেখে যান। তিনি বলেন, 'একজনের চোখের কর্নিয়া ফেটে গেছে। বিস্ম্ফোরণে কয়েকজনের অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা নিতে হবে আহত অনেককে।' চমেক হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তনুজা তাজনীন বলেন, 'হাসপাতাল থেকে অনেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় গেছেন। যাঁদের অবস্থা গুরুতর, তাঁদের এখনও চিকিৎসা চলছে। সবাইকে সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমরা।'
২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৫ বছরের যুবক আরিফ হোসেন চিকিৎসা নিচ্ছেন দুর্ঘটনার পর থেকেই। আরিফের চোখের জল মুছে দিচ্ছিলেন তাঁর মা হাবিবা বেগম। আরিফ বললেন, 'চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। কীভাবে কী হলো, তা এখনও বুঝতে পারছি না! চোখে এখনও ঝাপসা দেখি। ব্যথাও আছে খুব।' চোখের অবস্থা একেক দিন একেক রকম মনে হওয়ায় এখনও হাসপাতাল ছাড়তে পারেননি অনেকে। এই ওয়ার্ডে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ছয়জন।
৩৬ নম্বর বার্ন ওয়ার্ডে এখনও চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে চারজনকে। এঁদেরই একজন ২৫ বছর বয়সী মোসাদ্দেক। তাঁর শরীরের ওপরের অংশ গুরুতরভাবে পুড়েছে। সেই পুড়ে যাওয়া স্থানে এখনও আছে ক্ষত। হাসপাতালের বিছানায় প্লাস্টার করা মোসাদ্দেক কাতরাচ্ছেন যন্ত্রণায়। মোসাদ্দেক বললেন, 'কখন বাড়ি ফিরতে পারব, জানি না। আর কখনও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব কিনা, তা-ও জানি না! হাসপাতালে থাকতে আর ভালো লাগে না।' মোসাদ্দেকের পাশে ৩০ বছর বয়সী আরেক যুবক শুয়ে আছেন। তাঁর ডান হাত ও ডান পা পোড়া। পেটের একটি অংশও দগ্ধ তাঁর। পুড়ে যাওয়ায় শরীরের ওপরের অংশে প্লাস্টার নেওয়া এমন আরও তিনজন রোগী আছেন চমেকের বার্ন ইউনিটে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণে অনেকের দুই চোখে এখনও রয়ে গেছে 'লাল' আভা। এতে এখনও দুই চোখে ভালোভাবে দেখতে পারছেন না তাঁরা। এঁদের কেউ কাছাকাছি দূরত্বে দেখলেও দেখছেন না দূরে। অধিকাংশই দেখছেন ঝাপসা।
প্রিয়জনের এমন কষ্টে দুশ্চিন্তায় আহতদের স্বজনরাও। হযরত আলীর স্বজন মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, 'দুর্ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে আছি। আহত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ থেকে টাকাও পেয়েছি। শরীর যদি আর ঠিক না হয়, এই টাকা দিয়ে কী হবে? জীবনের বাকি সময়টা কীভাবে কাটাবে ক্ষতিগ্রস্তরা?'
চট্টগ্রামের বিএম কনটেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। ঘটনার ২৬ দিন পরও এ ঘটনার মূলহোতারা চিহ্নিত হয়নি। কেন আগুন থেকে এমন বিস্ম্ফোরণ হলো, সেটা এখনও রহস্যঘেরা। এটি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড- সুরাহা হয়নি সেই প্রশ্নেরও।
মন্তব্য করুন