
বৃষ্টির মধ্যে সড়কে ত্রাণের জন্য নারী-পুরুষের অপেক্ষা। বৃহস্পতিবার সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কে কোম্পানীগঞ্জের হাই-টেক পার্কের সামনের ছবি ইউসুফ আলী
সিলেট অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ীয় বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছেই। শুধু সিলেট জেলায় ৪১ হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুনামগঞ্জের অবস্থা আরও খারাপের আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। পানিবন্দি লাখো মানুষ খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার আশায় থাকলেও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা কাটছে না। বেসরকারিভাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলেও অনেকেই সরকারি কোনো ত্রাণ পাননি। সব মিলিয়ে ত্রাণ নিয়ে বন্যার্তদের বিড়ম্বনা কাটছে না।
সিলেট বিভাগের চার জেলায় সরকারিভাবে প্রায় ৪ হাজার টন চাল ও সাড়ে ৫ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এসব বিতরণ করা হচ্ছে। উপদ্রুত গ্রামাঞ্চলে বন্যার্তদের অনেকে সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি বলে দাবি করেছেন। জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ত্রাণ বিতরণের দাবি করলেও বন্যার্তরা পাননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার জনপ্রতিনিধিরা ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে বরাদ্দের অপ্রতুলতার কথাও বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বনাথের এক জনপ্রতিনিধি বলেন, 'আমাদের ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডে বন্যায় ১৫০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের জন্য মাত্র ২০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ হয়েছে। এখন কাকে বাদ দিয়ে কাকে সহায়তা দেব?'
এবারের বন্যায় সিলেট বিভাগের ৫৫ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন, যাঁদের অনেকের বাড়িঘর এখনও ডুবে আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভাগের দুর্গতদের জন্য সরকারিভাবে ৩ হাজার ৮৬৮ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ছাড়াও শুকনো খাবার দেওয়া হয়। সিলেট জেলায় ৪ লাখ ১৭ হাজারের মতো পরিবার পানিবন্দি হয়। সুনামগঞ্জে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৫৫ হাজারেরও বেশি। সিলেট জেলায় এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬১২ টন চাল বরাদ্দ হয়; এর মধ্যে ১ হাজার ৫৮৭ টন বিতরণ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে ১ হাজার ১১১ টন চাল বরাদ্দ হলেও মজুত থেকে উপদ্রুত এলাকায় আরও ২৪৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
গেল মে মাসের বন্যায় ৮-১০ দিন পানিবন্দি ছিলেন সিলেট জেলার লাখো মানুষ।
সেই বন্যার রেশ না কাটতেই জুনে দ্বিতীয় দফায় প্লাবিত হয়। দুই দফা কমবেশি ১৫ দিনের মতো পানিবন্দি মানুষের অনেকে সরকারি ত্রাণের শুধু সাত-আট কেজি চাল পেয়েছেন। বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে চলা মানুষ বেসরকারি ত্রাণের জন্য রাস্তায় ঘণ্টায় পর ঘণ্টা বসে থাকছেন। বিশ্বনাথের কাদিপুর দশদল গ্রামের নিজাম উদ্দিন বলেন, 'আমার পরিবারে ১৬ জন। এবারের বন্যায় ঘরে বুকসমান পানি ছিল। ১০ দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আশ্রিত ছিলাম। কেউ সহায়তা দেয়নি।'
বিশ্বনাথের রামপাশা কোনাপাড়া গ্রামের আবদুল আহাদ, জাহারগাঁওয়ের শাহিন মিয়া, জাগেরগাঁওয়ের রাশেদ আহমদদের কেউই সহায়তা পাননি। গোলাপগঞ্জ শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের লালনগর, সরস্বতীগ্রাম, কামারগাঁও এলাকায় বন্যার্ত শত পরিবারও কোনো ত্রাণ পায়নি। গত মে মাসের মাঝামাঝি এই ওয়ার্ডের অধিকাংশ বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এরপর জুনে ফের ওয়ার্ডের সিংহভাগ বাড়িঘর প্লাবিত হলে শত শত মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যেতে বাধ্য হন। পানি সামান্য কমলে অনেকের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গোলাপগঞ্জ শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফজলুল আলম বলেন, 'অবস্থা খুব খারাপ। কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যায় ভেঙে পড়েছে। যেসব ঘর টিকে আছে, সেখানেও পানি ও কাদা রয়েছে। মানুষ আছে নিদারুণ কষ্টে।' এদের সবাইকে ত্রাণ দেওয়ার কথা দাবি করলেও কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যাও বলতে পারেননি তিনি।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্প-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি-সংগঠনের লোকজন সিলেটে বন্যার্তদের সহযোগিতায় আসছেন। কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, লরি বোঝাই করে ত্রাণ এলেও এই ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা রয়েই গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও সরকারিভাবে কিছু সহায়তা দেওয়া হলেও অনেকেই ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। সীমান্তবর্তী কানাইঘাটের কান্দলা গ্রামের বিধবা মল্লিকা বেগমের বাড়ি বন্যায় ভেঙে পড়েছে। দু'বারে তিনি সরকারি বরাদ্দের ১৭ কেজি চাল পেয়েছেন। অর্থাভাবে ঘর মেরামত করতে না পারায় সন্তানদের নিয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এই নারী।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা সুনামগঞ্জে সরকারিভাবে বরাদ্দ করা চাল মাথাপিছু তিন কেজিরও কম। সুনামগঞ্জের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলার ১১টি উপজেলার ৫৫ হাজার ৬৬০টি পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ৩০ লাখ। গতকাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বরাদ্দ করা ১ হাজার ১১১ টন চালের পাশাপাশি মজুত থাকা আরও ২৪৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়; এর মধ্যে ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
সরকারি ত্রাণের অপ্রতুলতার অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিতরণে সমন্বয়হীনতার কথা মেনে নিয়েছেন সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ। তিনি বলেন, সরকারিভাবে ত্রাণের কোনো অপ্রতুলতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তবে মাঠ পর্যায়ে কিছু সমন্বয়হীনতা থাকতে পারে। এজন্য কেউ কেউ হয়তো দু-তিন দফা পাচ্ছে, আবার কেউ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা সুনামগঞ্জের প্রত্যেক উপজেলায় ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি।
বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্তদের সহযোগিতা না পাওয়ার বিষয়ে দেবজিৎ সিংহ বলেন, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হলে সংশ্নিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
মন্তব্য করুন