প্রায় ১৫ দিন পরও বন্যায় পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন দেশের সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের মানুষ। কয়েক দফায় পানি কমেছে-বেড়েছে। উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার স্থায়িত্বকালও বাড়ছে দফায় দফায়। এতে বন্যার্তদের মধ্যে বিপদ হয়ে হাজির হয়েছে রোগবালাই। এ অবস্থায় চলতি জুলাই মাসে ফের পানি বাড়ার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। তবে এবারের বন্যা দেশের মধ্যাঞ্চল দিয়ে বয়ে যেতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে গিয়ে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে। সামনের দিনগুলোতে বন্যা আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে মনে করছেন বন্যা ও নদী বিশেষজ্ঞরা। বন্যার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী দ্রুত প্রস্তুত করার পরামর্শ তাঁদের।

গত বৃহস্পতিবারের তুলনায় সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে শুক্রবার সকালে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে ২১ মিলিমিটার। এর আগের দিন বৃষ্টি হয়েছিল ১৮৫ মিলিমিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। বৃষ্টি হলেই জেলার নদনদীর পানি কিছুটা বাড়বে। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহ বলেন, মাঝখানে জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। এখন যেহেতু আবার বৃষ্টি হচ্ছে, তাই পানি কিছুটা বাড়ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পূর্বাভাস নেই।

কুড়িগ্রামে সম্প্রতি বন্যায় জনমনে রেখে যাওয়া দগদগে ক্ষতকে উস্কে দিতে জেলার ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে আবারও ধেয়ে আসছে উজানের ঢল। এতে আবারও প্লাবিত হচ্ছে নদীতীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা।

দেশের বন্যাদুর্গত এলাকায় অধিকাংশ রাস্তাঘাটের পানি নেমে গেলেও নতুন করে বৃষ্টিতে আবার তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় এখনও মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে বন্যার পানি আছে।

এ দিকে বন্যার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ফের জুলাইয়ে পানি বাড়ার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানাচ্ছে, আপাতত সিলেট অঞ্চলে নতুন করে বন্যার পূর্বাভাস নেই। তবে তিস্তার পানি বেড়ে গিয়ে উত্তরাঞ্চলে কয়েকটি এলাকায় সামান্য পানি প্রবেশ করতে পারে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, জুলাইয়ে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও যমুনার পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা হতে পারে। আর সে বন্যায় দেশের মধ্যাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।

গত ২৩ জুন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আগামী ১৫ দিন থেকে এক মাসের একটি বর্ধিত পূর্বাভাস দেয়। সে পূর্বাভাসে বলা হয়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আবারও নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম এবং একটি মাঝারি ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ২৩ জুন দেওয়া বন্যার পূর্বাভাসে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আপাতত ঈদের আগে এসব জেলায় বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে, ঈদের আগে যদি উত্তরবঙ্গের নদনদীগুলোর পানি বাড়তে থাকে, তাহলে ঈদের পরে মাঝারি ধরনের বন্যা হবে। তিনি বলেন, আমাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, জুলাইয়ে বাড়তি থাকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি, আর আগস্টে গঙ্গার। পানি বাড়লে বন্যার আশঙ্কা থাকেই। তবে ওই সময়ের বন্যার তীব্রতা কেমন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ তীব্রতা সবসময় উজানের ভারি বৃষ্টিপাতের ওপরে নির্ভর করে না। ভূমির ব্যবহার, নদনদীর গতিপ্রকৃতি ও পানি নিস্কাশনের ওপরও বিষয়টি নির্ভর করে। যে কারণে বন্যা দীর্ঘায়িত হয়।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ঈদের আগেই উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর নদীর পানি বাড়তে পারে। বন্যা হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি। এই সময় মাঝারি থেকে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানান তিনি। মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ৩ জুলাই যমুনার তীরবর্তী জেলাগুলো, ৩ থেকে ৫ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চল ও ৫ থেকে ৭ থেকে জুলাই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা শুরু হতে পারে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাত্র বর্ষা শুরু হযেছে, মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। বর্ষা মৌসুম এখন অক্টোবর পর্যন্ত গড়ায়। 'লা নিনা'র কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত এবং বন্যা হয়। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে 'মেডেন জুলিয়ান ওসিলেশন' (গ্রীষ্ফ্মম ীয় আবহাওয়ার ওঠানামা) এর সম্পর্ক আছে। বর্তমানে 'মেডেন জুলিয়ান ওসিলেশন' দুর্বল অবস্থায় আছে। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এটি সক্রিয় হবে। তখন এটি অবস্থান করবে ভারত মহাসাগরে। এতে বঙ্গোপসাগরে প্রচ মেঘ এবং জলীয় বাষ্প তৈরি হবে। বাতাস মেঘের পুরোটাই বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসে। তখনই মেঘালয় ও আসামে ভারি বৃষ্টি শুরু হবে। সেই বিবেচনায় জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আরেকটি বন্যার আশঙ্কা আছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আরেকটি বন্যার পূর্বাভাস রয়েছে। ওই সময় গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জ বেশি প্লাবিত হতে পারে। আমরা সিলেট থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছি।