চট্টগ্রামে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল প্রাণহানির ঘটনায় বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের দায় পেয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত ২৫ তদারকি সংস্থারও গাফিলতি পেয়েছে তারা। দায়িত্বশীলরা তাঁদের কাজে মনোযোগী না থাকায় অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে। ২৪ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন সারমর্ম টেনেছে তদন্ত কমিটি। ১৯ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদনের পাতায় পাতায় আছে বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বহীনতার চিত্র। রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডেল করা একটি কনটেইনার ডিপোতে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি। এমনকি ডিপোতে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও পায়নি তারা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে এর আগে চট্টগ্রাম বন্দর ও পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু মালিকপক্ষ ও তদারকি সংস্থার গাফিলতি নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের এই কমিটি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী কমিটি বিবেচনা করা হয়েছে ১২ সদস্যের এই কমিটিকে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তর, বন্দর, কাস্টমস, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। গত ৪ জুন রাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ও রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় ১৩ ফায়ারফাইটারসহ এ পর্যন্ত ৫১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি। ঘটনার কারণ জানতে ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে এর পর ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যাবে কেবল বিভাগীয় কমিশনার গঠিত কমিটির এই তদন্ত প্রতিবেদন।

বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে- বিএম ডিপোতে সর্বেসর্বা ছিলেন নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জিয়াউল হায়দার। কিন্তু ঘটনার আগে থেকেই তিনি অবস্থান করছেন সিঙ্গাপুরে। এত বড় দুর্ঘটনার পরও তিনি দেশে ফেরেননি। পাওয়া যায়নি তাঁর বক্তব্যও। ডিপোর জিএম (ম্যার্কেটিং) নাজমুল আক্তার খানেরও বক্তব্য পায়নি তদন্ত কমিটি। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক আছেন। নৌবাহিনীর অধীনে থাকা ডিজি কার্গো ইন্সপেকশন অফিসের দু'জন কর্মকর্তার হয়ে তদন্ত কমিটিকে বক্তব্য দিয়েছেন কমান্ডার বিএইচ সিরাজী। কিন্তু কমিটির রেকর্ডকৃত বক্তব্যে স্বাক্ষর করেননি তিনি। তবে এই কমিটি বিএম ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে, এই ডিপোর ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক মোস্তাফিজুর ও মুজিবুর। এই দুই ভাইয়ের শতভাগ মালিকানা আছে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সেও। দুর্ঘটনার পর মালিকানার বিষয় নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হলেও এই কমিটি তা স্পষ্ট করেছে তাদের প্রতিবেদনে।

বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হলে বিপুল পরিমাণের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেত বলেও মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। কনটেইনারে রাসায়নিক থাকার বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়নি ফায়ার সার্ভিসকে। রাসায়নিক থাকা কনটেইনার সংরক্ষণে যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার, তাও পালন করা হয়নি। ডিপোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফায়ার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা ছিল না। এ ব্যাপারে তাদের নিয়মিত কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো না। ফায়ার সার্ভিস এটি তদারকির দায়িত্বে থাকলেও তারা তা যথাযথভাবে তদারকি করেনি। লাইসেন্স দেওয়ার আগে এনবিআরের সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় প্রতিটি কনটেইনার ডিপোকে। কিন্তু এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। এনবিআর কিংবা তাদের অঙ্গ সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসও এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। দায়িত্বের প্রতি সচেতন ছিল না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য খালাস হয় বেসরকারি ১৯ কনটেইনার ডিপোতে। রপ্তানি পণ্যের শতভাগ শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এসব ডিপোতে। গুরুত্বপূর্ণ এমন কার্যক্রম পরিচালনার পরও যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই বেসরকারি ডিপোগুলোতে। এটি পাওয়া যায়নি বিএম কনটেইনার ডিপোতেও। পরিবেশ অধিদপ্তরও ডিপোর কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল না। পোলট্রি ফিডসহ বিভিন্ন পণ্য হ্যান্ডেলের কথা বলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সনদ নেওয়া হলেও তা মনিটরিং করেনি কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে ২৫টি তদারকি সংস্থার গাফিলতি ছিল।

তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতাও দেখতে পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে এনে কার্যক্রম মনিটরিং করা হলে এমন দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে এড়ানো যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। ২০১৬ সালের অফডক নীতিমালায় উল্লেখ থাকা ২৫টি বিভাগের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার জোর প্রস্তাব তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ২৫ বিভাগকে আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পাবে, কে পাবে না, কারটি বাতিল হবে, কেন বাতিল হবে- এমন সব প্রশ্নের উত্তর জানবে সবাই। স্বচ্ছতা তৈরি করা গেলে কার্যক্রমে জবাবদিহিতা আসবে বলেও মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি।

শ্রমবিধি অনুযায়ী, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি নিশ্চিত, অগ্নিনির্বাপণে পানির রিজার্ভার, ফায়ার হাইড্রেন্ট ও চার মাস অন্তর মহড়া দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা থাকলেও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে কেউ তা করে না। বিএম ডিপোতে আগুনের সময় পানি সংকটে হিমশিম খেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার হাইড্রেন্টও পাননি তাঁরা। ছিল না পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারও। ফায়ার সার্ভিসকেও এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন কমিটির সদস্যরা।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংশ্নিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া থেকে শুরু করে তদন্তের স্বার্থে যা যা করা প্রয়োজন ছিল, তার সবই করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। সবার সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এটি এখন আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব। সেখান থেকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, তদন্ত কাজটি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করেছি। এ কাজে সব পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়েছি। আমরা দুর্ঘটনাস্থলে সরেজমিন গিয়েছি। কারা এর জন্য দায়ী তা নির্ধারণের চেষ্টা করেছি। বিএম কর্তৃপক্ষের নানা ব্যর্থতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এত বড় প্রতিষ্ঠান হলেও সেখানে ছিল না কোনো সিসিটিভির ব্যবস্থা। এ কারণে তথ্য সংগ্রহ করতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের জিএম ও ইডিকেও আমরা পাইনি। এক কথায় বলা চলে, এত বড় বিস্ম্ফোরণের ঘটনার জন্য বিএম কর্তৃপক্ষসহ সরকারি সব সংস্থাই দায়ী। এর দায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনোভাবে এড়াতে পারেন না।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার আবু নুর রাশেদ আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার পরিচালক মুফিদুল আলম, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের মেজর আবু হেনা মো. কাউসার জাহান, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম ও চট্টগ্রামের বিস্টেম্ফারক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন। কমিটিতে সদস্য সচিব ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার।