কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় ছাতিরচর ও সিংপুর ইউনিয়ন দুটি নদী ও হাওরের ঢেউয়ের আঘাতে ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর।

কয়েক দিন ধরে হাওরে তীব্র বাতাসের কারণে 'আফালে'র (দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সৃষ্ট বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব) পাশাপাশি ধনু ও ঘোড়াউত্রা নদীর ব্যাপক ঢেউয়ের আঘাতে সৃষ্ট ভাঙনে বিপর্যস্ত গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-সংসার।

গ্রামের অসংখ্য মানুষ তাঁদের বসতবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের আত্মীয়স্বজনের ঘরবাড়িতে। অনেকেই পরিত্যক্ত খোলা জায়গায় বসতঘরের চালা অস্থায়ীভাবে বসিয়ে রাত পার করছেন। ভাঙনকবলিত এসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই।

গ্রামের মানুষ জানান, তাঁরা কচুরিপানার মতো ভাসছেন। তাঁদের দেখার মতো কেউ নেই। আফাল আর নদীর ঢেউ যে কোনো সময় তাঁদের বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁদের ঘরবাড়ি, সংসার ও জীবনের কোনো মূল্য কারো কাছে নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করেন।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দিনে নিকলীর ছাতিরচর, গোরাদীঘা, সিংপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে হাওর ও নদীভাঙনে কয়েকশ পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে। অন্যদিকে এক সপ্তাহের আফালে হাওরাঞ্চলের শতাধিক গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভাসিয়ে নিয়েছে অগণিত ঘরবাড়ি। হেলে পড়েছে এলাকার মসজিদ-মন্দির। যে কোনো সময় তা নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

ছাতিরচর গ্রামের আলী হোসেন (৩৫), হয়রত আলী (৫২), সিংপুর গ্রামের ইমাম হোসেন (৪৭), আবুল কাসেমসহ (৪৪) অর্ধশতাধিক ব্যক্তি জানান, বর্ষার শুরুতেই সিংপুর ও ছাতিরচরে নদীভাঙন শুরু হয়। বর্ষার এই মাঝামাঝি সময়ে হাওরের আফাল ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হাওরবাসী ভাঙন প্রতিরোধে বাঁশ, খড়, কচুরিপানা এমনকি ঘরের বেড়া বাড়ির পাশে ফেলে 'ঘায়ালে'র (স্থানীয় প্রযুক্তিতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা) ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এবার ঘায়াল ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে কাজে না আসায় ভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

প্রবল ঢেউয়ে ভাঙন ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় গত কয়েক দিনে কেবল সিংপুর ও ছাতিরচরেই পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর ধনু ও ঘোড়াউত্রা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামবাসী জানান, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের যথাযথ খোঁজখবর নিচ্ছেন না।

সিংপুর গ্রামের মধ্যবয়সী নারী জোসনা বেগম জানান, সারাদিনই পানিতে পড়ে থাকতে হয়। একটু বাতাস হলেই তাঁর মতো শত শত মানুষের মনে ভাঙনের আতঙ্ক বেড়ে যায়। ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে তাঁদের সময় পার করতে হচ্ছে।

জানা গেছে, কয়েক বছরের ভাঙনের ফলে দুটি ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হওয়ায় কমপক্ষে দুই হাজার পরিবার ছিন্নমূল হয়েছে।

সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, এবারের নদীভাঙনে সিংপুরে অর্ধশত বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ ও শতাধিক বাড়িঘর।

ছাতিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইয়ার খান বলেন, গত কয়েক বছরে গ্রামের ৪০০-৫০০ পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তাঁরা স্থানীয়ভাবে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। কিন্তু শক্তিশালী ঢেউ আর স্রোতের কারণে তা টিকছে না।

নিকলীর ইউএনও আবু হাসান বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য চাল, টিন ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ভাঙন রোধে ১২ হাজার বালির বস্তা দেওয়া হয়েছে। ছাতিরচর ও সিংপুরকে ভাঙন থেকে রক্ষা করতে নদী পুনঃখনন, নদী শাসন ও খাল কাটার মতো বড় ধরনের পরিকল্পনা নিতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান জানান, সিংপুর ও ছাতিরচরকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা ২০ হাজার বালির বস্তার ব্যবস্থা করেছেন। ছাতিরচরকে রক্ষা করার জন্য ৫৪ কোটি ৭১ লাখ টাকার প্রকল্প এবং সিংপুর গ্রাম ও বাজারকে রক্ষা করতে ৬৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার প্রকল্প ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। টেন্ডার আহ্বান করে কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরই ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।