
প্রতীকী ছবি
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরাদী ইউনিয়নের ঘাগুটিয়া গ্রাম। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ভালো নেই এই গ্রামের মানুষ। চরাদী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই প্রার্থীর জয়-পরাজয় 'আটকে' রেখেছে এখানকার উন্নয়ন। কেটে দেওয়া হয়েছে গ্রামের বেড়িবাঁধ। পানির তোড়ে তলিয়ে গেছে পুকুর, ভেঙে গেছে ঘরবাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নির্মাণ হয়নি সেতু কিংবা কালভার্ট। ভোটের প্রতিহিংসায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এমন রোষানলে পড়ে গ্রামবাসী শিকার ভাগ্য বিড়ম্বনার।
স্থানীয়রা জানান, ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯২ সালে। ওই বছর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী শফিকুল ইসলামকে সমর্থন দেন ঘাগুটিয়া গ্রামের ভোটাররা। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হন অপর প্রার্থী আব্দুল আউয়াল মন্টু।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, ভোটে সমর্থন না দেওয়ায় ১৯৯৬ সালে গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঘাগুটিয়া খালের ওপর নির্মিত বেড়িবাঁধ ৬টি স্থানে কেটে দেন চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মন্টু। তবে চেয়ারম্যানের সমর্থকরা দাবি করেন, এই এলাকায় পরিবেশ রক্ষায় এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে আদালতের নির্দেশনায় বাঁধ কেটে দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটের সময় যাঁরা মন্টুর বিপক্ষে ছিলেন, তাঁদের ধারণা- প্রতিহিংসায় মন্টু এ বাঁধ কেটে দেন। এটা ঠিক নয়। কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে অভিযোগ করে কয়েকশ মানুষ জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন বাঁধ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে গ্রামের লোকজন আদালতেরও শরণাপন্ন হন। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ের ভিত্তিতে বাঁধ কেটে দেওয়া হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বেড়িবাঁধ কাটায় খালের পানি ফসলের জমিতে প্রবেশ করে নিচু এলাকার বাড়ি তলিয়ে যায়, গাছপালা, ঘর, পুকুর ভেঙে খালের সঙ্গে মিশে যায়। এ ছাড়া পানির স্রোতে দুই পাড়ের অনেক জমি ভেঙে পড়েছে। বাঁধের ৬টি স্থান কেটে ফেলা হলেও তিনটি জায়গায় এখনও সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ হয়নি। আবার যেসব জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব সেতুও ভেঙে গেছে। বর্তমানে এসব বাঁধের ওপর বাশের সাঁকো দিয়ে চলছে চলাচল।
স্থানীয়রা আরও বলেন, ১৯৯৮ সালের ইউপি নির্বাচনে শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে তিনিও খালের ওপর কোনো সেতু নির্মাণ কিংবা এলাকার জনগণের দুর্দশা কমাতে উদ্যোগ নেননি। 'এই দুর্দশার জন্য মন্টু চেয়ারম্যান দায়ী'- ভোটের সময় জনগণ এটা যেন ভুলে না যায়, সে জন্যই শফিকুল উদ্যোগ নেননি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
২০০৭ সালে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল হোসেন হাওলাদার দৌড়ঝাঁপ করে একটি সেতু প্রকল্প অনুমোদন নিতে সক্ষম হন। কিন্তু সেই সেতু নির্মাণের সময় খালের পানি শাসনে কোনো বন্দোবস্ত নেওয়া হয়নি। এর ফলে পানির তোড়ে সেতুর দুই পাশের মাটি সরে যায়। সেতুটিও ভেঙে একদিকে হেলে পড়ে।
২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে ইউপি সদস্য পদে এলাকার মানুষ আওয়ামী লীগ নেতা টিক্কা খানকে সমর্থন জানালেও তিনি পরাজিত হন। বিজয়ী হন অপর প্রার্থী জুলহাস। ২০২২ সালে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই এলাকায় একটি সেতু প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাটি পরীক্ষা থেকে শুরু করে অন্যান্য সমীক্ষাও শেষ করা হয়। কিন্তু এখানেও ভোটের প্রতিহিংসার কারণে ইউপি সদস্য জুলহাস সেতুটিকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যান বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল বাসার বলেন, ঘাগুটিয়া খালের আফজাল হাওলাদারের বাড়ির সামনের সেতুর জন্য প্রকল্প পাস হয়েছে বলে জানি। এর জন্য তিন দিন ধরে খালের মাটি পরীক্ষা, জরিপ, পরিকল্পনা তৈরির জন্য প্রকল্পের লোক এলাকায় ছিলেন। কিন্তু কী কারণে প্রকল্প এখান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়েছে জানি না।
ইউপি সদস্য জুলহাস বলেন, প্রকল্প সরকারের, তা সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে যতটুকু জানি- এখানের সেতুর জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা বরাদ্দ হয়নি। ফলে এক কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দকৃত প্রকল্পটি ডাকুয়া বাড়ির সামনে সরে গেছে।
সাবেক চেয়ারম্যার আব্দুল আউয়াল মন্টু বলেন, ফসলের জন্য পানি এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন ও আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ওই সময় বাঁধ কেটে দেওয়া হয়। এখানে প্রতিহিংসার বিষয় নেই। তিনি আরও বলেন, এলাকায় এক সময় চারটি খাল ছিল; এখন রয়েছে মাত্র একটি।
১৯৯৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এই এলাকার চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই থাকেন। তার বড় ভাই শামসুল আলম চুন্নু বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। সপ্তাহে দুই দিন এলাকায় থাকেন জানিয়ে শফিকুল বলেন, সেতুর অভাবে ঘাগুটিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। এ জন্য তিনি প্রকল্প পাসের চেষ্টা করছেন।
মন্তব্য করুন