বরগুনার আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকে ১০০ মিটার গেলেই আমতলী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে হাওলাদার বাড়ি। উপজেলা শহরের বুকে এখন সবুজ ছায়াঘেরা মনোরম বাড়ি পাওয়া শুধু দুর্লভ। চার বিঘা জমিতে বাড়িটির বিস্তীর্ণ অংশ পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বাড়ির মালিক সুকুমার হাওলাদার পাখির প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজির গড়েছেন। তাদের খাবার জোগানে মাছভরা পুকুর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। প্রতিবছর বাড়িয়ে চলেছেন বনাঞ্চল।

মজার বিষয়, বাড়িটি চড়ূই, শালিক, ঘুঘুসহ নানা প্রজাতির পাখির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলেও আধিক্য বক, পানকৌড়ি ও বাদুড়ের। সুকুমারের কারণে কেউই এখানে পাখি শিকার দূরে থাক; জ্বালাতন পর্যন্ত করার সাহস দেখায় না। এটি সবার কাছে পাখিপ্রেমী বাড়ির পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ পাখি আর প্রাণ-প্রকৃতির নির্মল সঙ্গ পেতে হাওলাদার বাড়ি আসছেন।

গোটা বাড়ি পাখির জন্য অভয়ারণ্য করার পেছনেও রয়েছে মজার গল্প। প্রায় এক যুগ আগে সুকুমার হাওলাদারের বাড়ির গাছে কয়েকটি বাদুড় বসবাস শুরু করে। বছর না ঘুরতেই বাড়িটি কয়েক হাজার বাদুড়ের আবাসে পরিণত হয়। সুকুমারেরও বিষয়টি ভালো লেগে যায়। বাদুড় যেসব খাবার পছন্দ করে, তা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর পর বাড়িতে আসতে থাকে বক ও পানকৌড়ি। বাড়ির পেছনের উঁচু রেইনট্রি, বাতাবি লেবু, কড়ই ও চাম্বল গাছে হাজার হাজার বাদুড়ের সঙ্গে কয়েকশ বক ও পানকৌড়ি রয়েছে। সুকুমারের নির্ভরতা পেয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে এসব পাখি।

সাধারণত মে-জুনে পানকৌড়ি ও বক বাড়ির গাছে বাসা করে ডিম পেড়ে ছা ফোটায়। এই সময় ছানাদের নিয়ে মা বক ও পানকৌড়ি ব্যাপক খাদ্য সংকটে পড়ে। বিষয়টি টের পেয়ে সুকুমার বাড়ির পেছনের পুকুর থেকে নিজেদের জন্য মাছ ধরা বন্ধ করে দেন। সেখানে আরও বেশি করে পোনা ছেড়ে পাখিদের জন্য উন্মুক্ত রাখেন। পানকৌড়ি ও বকের দল পুকুরে নেমে মাছ শিকার করে তা ছানাদের খাওয়ায়। প্রতি বছর মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাড়িটিতে বক আর পানকৌড়ির রীতিমতো মেলা বসে। বাচ্চা বড় করে পানকৌড়ি ও বক চলে গেলেও সারাবছর বাদুড়, শালিক, চড়ূইসহ অন্যান্য পাখি থেকে যায়।

সরেজমিন ভরদুপুরে হাওলাদার বাড়ির উঁচু রেইনট্রি, কড়ই ও চাম্বল গাছে বাদুড় ঝুলতে দেখা যায়। কিচিরমিচির শব্দে মুহূর্তে মন ভালো হতে বাধ্য। রেইনট্রির মগডালে বক ও পানকৌড়ির সারি সারি বাসা। অনেক বাসায় বকের বাচ্চা ফুটেছে। কিছু বাসায় মা বক ও পানকৌড়ি ডিমে তা দিচ্ছে। বকের বিষ্ঠায় গাছের সব পাতার রং হয়ে গেছে সাদা।

সুকুমার হাওলাদার জানান, শুরুতে কষ্ট হলেও এখন তাঁদের পরিবারের সবাই পাখির প্রেমে পড়ে গেছেন। পাখির কষ্টে সবাই ব্যথিত হন। পেছনের অংশের বড় গাছ কেটে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পাখির কথা ভেবে সবাই সরে আসেন। এখানে পাখিকে বিরক্ত করা একেবারে নিষিদ্ধ। এলাকাবাসীও দারুণ সহায়তা করেন। অনেকেই এখন নিজের বাড়ি পাখির অভয়ারণ্য করছেন।

প্রতিবেশী ধীরাজ বিশ্বাস বলেন, পাখির প্রতি সুকুমার হাওলাদারের ভালোবাসা আমাদের মুগ্ধ করে। অভয়াশ্রম গড়তে আমরাও তাঁকে সহায়তা করি। বলা চলে, সুকুমারকে দেখেই আমাদের এলাকার মানুষ পাখির প্রেমে পড়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান বলেন, উঁচু গাছপালা ও নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে বক, পানকৌড়ি ও বাদুড়। সুকুমার হাওলাদার পাখির জন্য যা করছেন, নিঃসন্দেহে তা অনুপ্রেরণার। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এলে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে; রক্ষা পাবে প্রাণ-প্রকৃতি।