
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৩ সালে ১৫ জুন। এরপর ৯ বছর ধরে ছড়া-খাল উদ্ধার, অবৈধ স্থাপনা ও হকারদের উচ্ছেদ, সড়ক ও ড্রেনের উন্নয়ন- এ পঞ্চযজ্ঞেই সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা গেছে নগর কর্তৃপক্ষকে। ঘুরেফিরে প্রতিবছর এই কর্মযজ্ঞেই ব্যস্ত সময় পার করেন নগরপিতা আরিফুল হক। এজন্য অনেকে তাঁকে 'ভাঙাগড়ার মেয়র' সম্বোধন করেন।
এ ছাড়া গত কয়েক বছরে নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বা সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের অধিকাংশই ঠিকমতো শেষ করতে পারেননি তিনি। একটি প্রকল্পের কাজ শেষ না করতেই আরেক প্রকল্প শুরু করায় নগরবাসীও পোহান 'উন্নয়ন দুর্ভোগ'। গত কয়েক বছরে এই 'উন্নয়নযজ্ঞে' শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও নগরবাসী পায়নি কাঙ্ক্ষিত সুফল। ড্রেনেজ ব্যবস্থার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও একটু বৃষ্টি হলেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এখনও নাগরিকদের সুপেয় পানি, মশা ও ড্রেনেজ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি মেয়র। এমনকি সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সেবা পেতেও দিনের পর দিন ঘুরতে হয় সংশ্নিষ্টদের দ্বারে দ্বারে।
প্রথম দিকে কিছু ক্ষেত্রে মেয়রের সিদ্ধান্ত প্রশংসা কুড়ালেও উন্নয়নের ধীরগতি এবং সফলতা ধরে রাখতে না পারায় এখন অনেকেই করছেন সমালোচনা। নগরবাসীরা জানান, ২০১৩ সালে দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মাথায় নগরীর গোয়ালি ছড়া উদ্ধারে নামেন মেয়র। দীর্ঘদিন ধরে ছড়া-খাল দখল করে গড়া অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং খালের নাব্য ফিরিয়ে আনার অভিযানের কারণে তখন নগরবাসীর বাহবা পান তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয় পান তিনি। দুই মেয়াদে ৯ বছরের মধ্যে দুই বছর কারাগারে থাকার সময় বাদে প্রায় ৭ বছরই করেছেন ভাঙাগড়ার কাজ। প্রায় প্রতি বছরই নগরীর গাভিয়ার খাল, গোয়ালি ছড়া, মালনীছড়া, কালিবাড়ী ছড়া, ধোপা ছড়াসহ ১৭টি ছড়া-খাল উদ্ধার ও উন্নয়নের কাজ করে আসছে নগর ভবন। এ খাতে ব্যয় হয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা। এ ছাড়া সড়ক ও ড্রেন প্রশস্ত করার প্রকল্পেও ব্যয় হয়েছে শতকোটি টাকা। তবে তার সুফল খুব একটা পাওয়া যায়নি।
মেয়র আরিফের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ। তবে নগরীর প্রধান কয়েকটি সড়ক থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান 'চোর-পুলিশ খেলা'র মতো। গত ৯ বছর ধরে স্থায়ী কোনো সুফল আসেনি এতে। নগরীর লালদীঘিরপাড়ে হকারদের জন্য আলাদা স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও হাতেগোনা কয়েকজনের বাইরে কেউ সেখানে নেই। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রধান কয়েকটি সড়ক থেকে হকার উচ্ছেদ করে 'হকারমুক্ত এলাকা' ঘোষণা করেন মেয়র। এতে কিছুদিন স্বস্তি ফিরলেও বর্তমানে ফের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা শুরু করেছেন হকাররা। খোদ নগর ভবনের সামনের ফুটপাতও এখন তাদের দখলে। এ ছাড়া নগর ভবনের কয়েকশ গজ দূরে কোর্ট পয়েন্ট থেকে জেলরোড রাস্তা পর্যন্ত এলাকা থেকে অস্থায়ী সবজি ব্যবসায়ীদের সরানো যায়নি। অথচ ব্যস্ততম ওই এলাকায় তাদের কারণেই দিন-রাত যানজট লেগে থাকে।
স্থাপনা উচ্ছেদ ও করপোরেশনের জমি উদ্ধারও চলে প্রতি বছর। এতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় হলেও তালিকানুযায়ী কাজ শেষ করতে পারেনি সিসিক। ২০১৬ সালে নগরীর ৩২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে উচ্ছেদ শুরু হলেও ছয় বছরেও তা শেষ করা যায়নি। সিসিকের মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের অংশ বিশেষ ভাঙার পর আর হাত দেওয়া হয়নি। তবে অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ চলছে নিয়মিতই। সবশেষ সড়ক প্রশস্তকরণ ও ড্রেন নির্মাণকাজ নির্বিঘ্ন করতে গত শনি ও রোববার পাঠানটুলা এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন মেয়র। এতে সওজের জায়গায় নির্মিত একটি বহুতল ভবনসহ একাধিক ভবনের অংশ বিশেষ ভাঙা হয়েছে।
প্রতি বছর এমন অভিযানের সুফল কী জানতে চাইলে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, সময় ও চাহিদা অনুযায়ীই কাজ করা হয়। গত কয়েক বছরে কিছু কাজে শতভাগ এবং কিছু কাজে ৪০-৫০ ভাগ সফলতা এসেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ভাঙাগড়ার এই প্রক্রিয়ায় নগরীর কিছু এলাকা নান্দনিকও করে তুলেছেন মেয়র আরিফ। নগরীর প্রধান ব্যস্ততম সড়ক বন্দর থেকে চৌহাট্টা মোড় এবং চৌহাট্টা থেকে বিকাবিবাজার-সুবিবাজার মোড় পর্যন্ত বৃক্ষল্যান্ড করে নান্দনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ছাড়া মদিনা মার্কেট-আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়কের অংশ বিশেষ এবং সোবহানীঘাট-শাহজালাল সেতুর মুখ পর্যন্ত সড়কে আইল্যান্ড এবং জেলরোড, মিরবক্সটুলাসহ বেশ কিছু সড়ক প্রশস্ত করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পাশাপাশি কয়েক বছরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে সাতটি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছেন। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে বছরের পর বছর ভোগান্তির শিকার হয়েছে নগরবাসী।
সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। যখন যা মনে হয়, মেয়র তাই করবেন সেটা ঠিক নয়। একটা কাজ শেষ করে আরেকটা কাজে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানান, নগরী ও নগরবাসীর স্বার্থে একই সময় একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সরকার প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি শেষ করার সময়ও বেঁধে দেয়। সময়মতো কাজ না করলে বরাদ্দ চলে যায়। একটি করে কাজ করতে গেলে ২০ বছরেও শেষ হবে না। তিনি বলেন, ছড়া-খাল উদ্ধার, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ এবং অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদের কাজ ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদের বিষয়টি শেষ করা যায়নি।
প্রতিবছর একই ধরনের কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, এক সময় ছড়া-খাল খনন এবং পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেই কাজ শেষ করা হতো। এখন প্রাচীরও নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ২৭টি ওয়ার্ডে একসঙ্গে একই পদ্ধতিতে ড্রেন করা হচ্ছে। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক বা ড্রেন প্রশস্ত করতে হয়। উন্নয়ন কাজের জন্য নগরবাসীর ভোগান্তি নিয়ে বলেন, কাজ করতে গেলে সাময়িক অসুবিধা হবে। এক সঙ্গে অনেক কাজ চলছে। এখন কেউ পরামর্শ না দিয়ে সমালোচনা করলে সেটা দুঃখজনক।
মন্তব্য করুন