মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে আবারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়াল সরকার। গত নভেম্বরে এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে তা হয়ে গেল ১১৪ টাকা। এবার শুধু ডিজেল ও কেরোসিনের দামই বাড়েনি, পেট্রোল ও অকটেনের দামও বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ১১৫ ও ১৩০ টাকা। আগে এ দুটি আইটেমের দাম ছিল ৮৯ ও ৮৬ টাকা। পেট্রোল ও অকটেনের ব্যবহার এখানে খুব বেশি নয়- দুটি মিলিয়ে বছরে মাত্র ৫-৬ লাখ টন ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যবহারকারীও প্রধানত সচ্ছল মানুষরা। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি খুব একটা আলোচ্য বিষয় নয়।

আমাদের উদ্বেগের জায়গাটা হলো, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি শুধু নয়, অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এক লাফে একেবারে লিটারে ৩৪ টাকা বৃদ্ধি অতীতে কখনও দেখা যায়নি। তাছাড়া, এমন এক সময়ে এ ঘটনা ঘটল যখন নভেম্বরের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাই মানুষ এখনও সামাল দিতে পারেনি। ওই সময় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একদিকে সব ধরনের পরিবহন ভাড়া প্রায় দেড় গুণ হয়ে যায়, অন্যদিকে বৃদ্ধি পায় কৃষি ও শিল্প পণ্যের দাম। আর করোনার ধাক্কা তো ছিলই। প্রায় দুই বছরের এ মহামারি কতজনের জীবিকা খেয়েছে, কতজনের আয় কমিয়ে দিয়েছে এবং কত পরিবারকে শহর থেকে গ্রামের প্রায় কর্মহীন জীবনে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে তার কোনো হিসাব নেই। অন্তত শতবছরে নজিরবিহীন এ মহামারির প্রভাব জনজীবন থেকে এখনও একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার ধাক্কা মানুষ বিশ্বের অপরাপর দেশের জনগণের মতো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে আগে থেকেই বিশেষ করে স্থির আয়ের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী ছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে আর নামতে দেয়নি বরং এর বেগ বাড়াতে জ্বালানি জুগিয়েছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশে বছরে ৫৫ লাখ টনের মতো ডিজেল লাগে এবং এর পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ ডিজেলের ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত, ১৮ শতাংশ কৃষি, প্রায় ৮ শতাংশ শিল্প এবং বাকিটা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গৃহস্থালি খাতে। অর্থাৎ ডিজেল শুধু পুরোপুরি জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট পণ্য নয়, আমজনতার জীবনের স্বস্তি নির্ভর করে এর সুলভতার ওপর।

সরকার বলছে, তারা আর পারছিল না, তাই জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অপরিশোধিত তেলের দাম যখন মার্চে ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছুঁয়েছিল তখন পারা গেল আর এখন যখন তা কমে ৯৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে তখন পারা যাচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের অনেকে এমনটাও বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের এ নিম্নগতি অব্যাহত থাকবে; এমনকি কেউ কেউ এমনও বলছেন তা ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলারে নেমে আসবে। তাঁদের এমনটা মনে করার কারণ হলো, ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই একটা মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে। কারও কারও মতে, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ একসঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি মন্দায় পড়তে যাচ্ছে। তখন জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমে আসবে এবং এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে এর দাম ওই পর্যায়ে নেমে যাবে। এ বিষয়গুলো জানার পরও আমাদের সরকার এখনই একরকম তাড়াহুড়া করে এমন একটা অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নিল কেন?

সবাই যে বলছেন, সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের পেছনে আছে বিশেষ করে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের বিদ্যমান ঘাটতি মেটাতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক এ ঋণদাতা সংস্থাটির চাহিদা পূরণ তা বেঠিক নয়। তবে এমনটাও কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান গোলমেলে পরিস্থিতিকে সরকার আসলে এক ধরনের শাপেবর হিসেবে দেখছে; তারা বহুদিন ধরেই বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহারের কথা বলে আসছিল। তাই জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় এতটাই বাড়ানো হলো, তাতে এ খাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

কিন্তু এ ধরনের একটা সিদ্ধান্তের কারণে সরকারকে রাজনৈতিকভাবেও খেসারত দিতে হতে পারে- তা হয়তো তারা ভুলে গেছে। নীতিনির্ধারকরা হয়তো ভেবেছেন, লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়লে যতটুকু সমালোচনা শুনতে হবে, এর তিন গুণ বাড়ালেও একই মাপের প্রতিক্রিয়া সইতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে সব হিসাব সব সময় একই ফল দেয় না।

কে অস্বীকার করবে যে, গত এক যুগে ক্ষমতায় থেকে সরকার রাজনৈতিক অঙ্গনে তার নতুন কোনো বন্ধু বানাতে পারেনি, বরং পুরোনো বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এর মধ্যে আবার অনেক রাজনৈতিক দল শাসক দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব পেতেছে। এমনকি হতে পারে না, যে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার সম্পর্কে প্রায় একই রকম মূল্যায়ন সত্ত্বেও নানা কারণে বিএনপি থেকে এতদিন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল জ্বালানি তেলের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ওই উভয় পক্ষকে আরও কাছাকাছি নিয়ে গেল? যদি এমনটা ঘটে তা যে বর্তমান সরকারের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দেবে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

এই যে ভোলায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বুলেটের মুখেও পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়ালেন- গত সাত বছরে এমন দৃশ্য কেউ কল্পনাও করেনি। এর উৎস কি বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে লোডশেডিংসহ সরকারের কৃচ্ছ্র সাধন কর্মসূচির কারণে সৃষ্ট জনঅসন্তোষ নয়? যেভাবেই হোক সরকার অন্তত গত ৭-৮ বছর মানুষকে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে দেশের প্রায় শতভাগ এলাকার বিদ্যুতায়ন ঘটেছে- এটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এ আত্মতুষ্টি থেকে সরকার যদি ভেবে থাকে জনগণ মাসের পর মাস লোডশেডিং মেনে নেবে কিংবা জ্বালানি তেলের মতো অপরিহার্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মুখ বুজে সহ্য করবে, তাহলে তা বাস্তবসম্মত কোনো ভাবনা হবে না। কারণ, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে মানুষ এমনও ভাবতে পারে, সরকার তাদের দুর্ভোগের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। মোদ্দা কথা হলো, মানুষের পিঠ যদি দেয়ালে ঠেকে যায়, মানুষের কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তাই আমাদের পরামর্শ, সরকার বরং জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এতটা না বাড়িয়ে তার ক্ষীয়মাণ রাজকোশ পূরণে অন্য কোনো উপায় নিয়ে ভাবুক।

সাইফুর রহমান তপন: সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা