- সারাদেশ
- 'ক্রীতদাসের' জীবনে ৩০০ টাকার সংগ্রাম
চা শ্রমিকদের কষ্টগাথা
'ক্রীতদাসের' জীবনে ৩০০ টাকার সংগ্রাম

বংশপরম্পরায় ভাঙা ঘরে বসবাস। সিলেটের দলদলি চা বাগান থেকে রোববার তোলা-সমকাল
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক চন্দন কুর্মির জীবন আর চলছে না। সকাল-বিকেল পরিশ্রম করে ২৩ কেজি চা পাতা তুললে ১২০ টাকা মজুরি মেলে। অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে কাজে না গেলে সামান্য সেই অর্থও পান না।
সমকালকে তিনি বলেন, 'স্বামী-স্ত্রী কাজ করেও একমাত্র সন্তানের মুখে ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারি না। এখন চাল-ডাল, তেল-লবণের যে দাম, তাতে সামান্য টাকায় কী করে সংসার চলবে তা ভেবে স্থির থাকতে পারছি না।'
সিলেট সদর উপজেলার কালাগুল চা বাগানের শ্রমিক রিনা বাউরির জীবন আরও বেদনার। তাঁর কথায় উঠে আসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চা বাগানের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন-সংগ্রামের আলেখ্য। তিনি বলেন, 'এই বাগানেই আমার জন্ম। স্বামীর ঘরও এখানে। আমার বাবা-মা এখানে কাজ করেছেন। আমরা করছি। ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানরাও করবে। সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে যে ভালো পেশায় পাঠাব, সেই সামর্থ্যও আমাদের নেই। প্রাথমিকের পর পড়ালেখার সুযোগ নেই। তাই শ্রমিকের জীবনই ভাগ্য।'
নগরীর উপকণ্ঠে দলদলি চা বাগানের ৬৫ বছরের মন্টু বাল্মিক দাস এখন আর কাজে যেতে পারেন না। পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে বাগানেই কাজ করেন। ছেলেদের স্ত্রীরাও চা শ্রমিক। তার পরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। একবেলা ভর পেটে খেলে দু'বেলা কার্যত অভুক্ত থাকতে হয়। অসুস্থ মন্টুর চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও নেই। জরাজীর্ণ ঘরের দুয়ারে নাতিকে কোলে নিয়ে বসে তিনি বলেন, 'চা শ্রমিকদের জীবন হচ্ছে কোনো রকমে বেঁচে থাকার লড়াই।'
কদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সারাদেশের চা শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে ধর্মঘট, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। সারাদেশে ১৬৭টি মূল চা বাগানের পাশাপাশি অনেক ফাঁড়ি (মূল বাগানের অধীন) বাগান রয়েছে। সব মিলে দেশে ২৪১টি চা বাগান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পংকজ কন্দ। দেশে প্রায় দেড় লাখ চা শ্রমিক রয়েছেন।
চা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, দেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মানবেতন জীবনযাপন করেন এ খাতের কর্মীরা।
চা শ্রমিকদের নিরন্তর জীবন-সংগ্রামের জন্য শিশুরা লেখাপড়া করতে পারেন না। ফলে চা শ্রমিক জীবনের চক্রেই আটকে পড়েন। নূ্যনতম মজুরিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে 'ক্রীতদাসের' মতো তাঁদের বাগানের শ্রমিক-জীবন মেনে নিতে হয়। প্রায় ২০ মাস ধরে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছে চা শ্রমিক ইউনিয়ন। তবে আলোচনায় কোনো সুরাহা হয়নি। চা বাগানের মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা দৈনিক ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন।
চা শ্রমিকদের জীবনমানের চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জরিপে। ২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত জরিপে দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশু খর্বাকায় ও ২৭ শতাংশ শীর্ণকায় হয়। এ ছাড়া ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্বল্প ওজনের হয়। এই জরিপ অনুযায়ী, চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর ৪৬ শতাংশ কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়। কিশোরী বয়সে ২২ শতাংশ মা হন। ৬৭ শতাংশের নূ্যনতম স্যানিটেশন সুবিধাও নেই।
২০১৮ সালে মৌলভীবাজারের চা বাগানের নারীদের ওপর একটি গবেষণা চালায় বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যান্সারে ভুগছেন। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, স্বল্প মজুরি, নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কারের কারণে অপুষ্টি ও রোগের শিকার চা বাগানের নারী ও শিশুরা।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি কারও দরদ নেই। শ্রম অধিদপ্তর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসায় আহ্বান জানিয়েছিল; আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি।
চা বাগানের মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের মজুরির পাশাপাশি বাসস্থান, সাপ্তাহিক রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়। এসব মিলে শ্রমিকদের ৪০৩ টাকা দেওয়া হয় বলেও যুক্তি দেওয়া হয়। তবে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সব মিলে খরচের পরিমাণ ১৭০ টাকার বেশি নয় বলে জানিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে রেশন বাবদ তিন কেজি ৩৩০ গ্রাম করে আটা বা চাল পান শ্রমিকরা। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাসপাতাল থাকার কথা।
চুক্তি অনুযায়ী চা শ্রমিকদের বসবাসের জন্য ২১ ফুট বাই সাড়ে ১০ ফুট ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। চা বাগানের বেশিরভাগ স্কুলে নামমাত্র একজন শিক্ষক প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেন। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার কথা বলা হলেও দু-তিন ধরনের বাইরে অন্য ওষুধ মেলে না। চিকিৎসক সংকটও রয়েছে।
জাতীয় শোক দিবসের কারণে চা শ্রমিকদের চলমান ধর্মঘট কর্মসূচি দু'দিনের জন্য বন্ধ রয়েছে। আজ সোমবার শোক দিবস উপলক্ষে জাতির পিতার পরিবারের স্মরণে কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানান শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ। আগামীকাল মঙ্গলবার হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়া, সিলেট এবং চট্টগ্রামে মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন চা শ্রমিকরা।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি: শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন বালিশিরা ভ্যালির চা শ্রমিক নেতারা। রোববার বিকেলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি তুলে দেন তারা।
মন্তব্য করুন