- সারাদেশ
- নেতাদের ওপর অনাস্থায় কাটছে না অচলাবস্থা
চা শ্রমিকদের আন্দোলন
নেতাদের ওপর অনাস্থায় কাটছে না অচলাবস্থা

আন্দোলন প্রত্যাহারের পর সোমবার সকালে কাজে যোগ দেন সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিকরা। ছবি- ইউসুফ আলী
চা শ্রমিকদের আন্দোলন শেষ হয়েও যেন হচ্ছে না। দফায় দফায় সমঝোতা বৈঠক শেষে নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সাধারণ শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতীতে চা বাগানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের 'আশ্বাসে' বিশ্বাস রেখে প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন শ্রমিকরা। আস্থার ওই সংকট দেশের চা শিল্পের অচলাবস্থা নিরসনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে সরাসরি বা ভার্চুয়ালি আশ্বাসবাণী শোনার অপেক্ষায় রয়েছেন শ্রমিকরা।
সর্বশেষ রোববার রাতে সিলেটে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সমঝোতা বৈঠকেও কোনো সমাধান হয়নি। একই সময় মৌলভীবাজারে জেলা প্রশাসক কার্যালয়েও অনুরূপ বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে রাত ৩টার দিকে 'প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান' রেখে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বানে চা শ্রমিক নেতারা সাড়া দেন। এমনকি সদ্য নির্ধারিত ১৪৫ টাকার বদলে আগের ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তেও সম্মতি দেন নেতারা। পাশাপাশি শারদীয় দুর্গাপূজার আগে দাবি আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স আয়োজনের জন্য শ্রমিক নেতারা অনুরোধ করেন। আশ্বাস পেয়ে কিছু বাগানের শ্রমিকরা কাজে ফিরলেও বেশিরভাগ শ্রমিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে শনিবার রাতের বৈঠকের পর নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলেও সাধারণ শ্রমিকরা ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন।
সিলেট নগরীর উপকণ্ঠে দেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ার শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সহসভাপতি সাধনা কালোয়ার বলেন, সিলেট জেলার ২২ বাগানের ভ্যালি সভাপতি রাজু গোয়ালা রাতের আঁধারে যে সমঝোতা করেছেন, তা তাঁরা মানেন না। রাজুর লাক্কাতুরা বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও তাঁরা কর্মবিরতি পালন করবেন। না খেয়ে মরলেও দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিভিতে ৩০০ টাকা মজুরি নির্ধারণের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা কাজে যোগ দেবেন না। প্রয়োজনে এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
মৌলভীবাজারের শমশেরনগরের কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান সন্তোষ রবিদাশ অঞ্জন জানান, চা বাগান মালিকরা শ্রমিকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্টদের বলেন, তা কাল্পনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, তাঁদের কল্পনাপ্রসূত পরিসংখ্যান দিয়ে দৈনিক মজুরি ৪০২ টাকা দেওয়ার হিসাব ভাওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়।
অচলাবস্থার নিরসন না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন শুরুর আগে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, ৩০০ টাকার এক পয়সা কমেও চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। এখন তাঁরা রাতের আঁধারে সাধারণ শ্রমিকদের অবহিত না করেই সমঝোতা করছেন। এতে শ্রমিকরা নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন। শ্রমিক নেতাদের অতীত ইতিহাস সুখকর না হওয়ায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল তো আছেই।
গত ১০ দিনের আন্দোলনের নেপথ্যে বাইরের ইন্ধন রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে সাধারণ শ্রমিকরা দাবিতে অটল। এমনকি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে সমঝোতায় রাজি হওয়ায় শ্রমিক ইউনিয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সাধারণ শ্রমিকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
দেশে মৌলভীবাজারে ৯২টি, হবিগঞ্জে ২৪টি ও সিলেটে ২২টি চা বাগানের পাশাপাশি এর অধীন অনেক ফাঁড়ি বাগানও রয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে এসব বাগানের শ্রমিকরা প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মিতিঙ্গা চা বাগানের শ্রমিক সঞ্জয় বাউরী বলেন, পঞ্চায়েত কমিটি থেকে শুরু করে ভ্যালি ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সমন্বয়ের অভাবের কারণে বৈঠক ফলপ্রসূ হচ্ছে না। হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে ভ্যালি কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক অনুপস্থিত থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি তাঁরা ভরসা রাখতে পারছেন না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁদের পাওয়া যায়নি। অন্য শ্রমিক নেতারাও আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হবিগঞ্জের একজন শ্রমিক নেতা বলেন, অতীতে সাধারণ শ্রমিকদের দাবি পূরণে নেতাদের ব্যর্থতা রয়েছে।
মন্তব্য করুন