মোহাম্মদ ফোরকান, ছাপোষা এক সরকারি চাকুরে। তাঁর ছোট চাকরি, তবে ভরপুর ক্ষমতা। এক ফোরকানই যেন ঘোল খাওয়াচ্ছেন সবাইকে। তাঁকে কোনোভাবেই যেন বোতলবন্দি করতে পারছে না চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁর নামে রয়েছে দরপত্র সিন্ডিকেট, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ ৩৭টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের এক চিকিৎসক নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ফোরকান এমন 'ঘাড় ত্যাড়া' বলে অভিযোগ সংশ্নিষ্টদের।

করোনার সময় হাসপাতালটির জন্য কেনা হয়েছিল আইসিইউ শয্যা আর ভেন্টিলেটর। তখন সেখানকার হিসাবরক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ ফোরকান। তাঁর বিরুদ্ধেই ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার একটি বিলে সই জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। পুরো ঘটনার জন্য ফোরকানকে দায়ী করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি। কমিটির সুপারিশেই তাঁকে শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয় মুন্সীগঞ্জের লৌহজং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

এই বদলির আদেশ মানতে পারেননি দাপুটে কর্মচারী ফোরকান। তাই বদলির আদেশ হওয়ার এক মাস পার হলেও তিনি যোগ দেননি নতুন কর্মস্থলে। এখনও বুঝিয়ে দেননি হিসাব শাখার গুরুত্বপূর্ণ নথি। উল্টো হিসাব কক্ষেই তালা ঝুলিয়েছেন এই কেরানি। এখানেই থেমে নেই ফোরকানের রংবাজি। অধিদপ্তরের আদেশকে থোড়াই কেয়ার করে উল্টো বদলির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলাও ঠোকেন।

মামলা খারিজ হওয়ার পর আবারও আপিল করেন ফোরকান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে প্রতিনিয়ত এও বলে বেড়াচ্ছেন, 'চট্টগ্রাম থেকে আমাকে কে বদলি করে দেখব।' তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসন ও অধিদপ্তর। নিরুপায় হয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ ১০ দপ্তরে চিঠি দিয়েছে।

ফোরকাননামা: রকমারি অনিয়ম আর দুর্নীতির পথে ফোরকান হাঁটছেন বেশ আগে থেকেই। এক নারীকে অপহরণের চেষ্টা করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেওয়া ফোরকানের বিরুদ্ধে তখন থানায় করা হয়েছিল সাধারণ ডায়েরি। নানা অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় এর আগেও বদলি হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। তবে অনিয়ম, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা কর্মকাণ্ড করে বেড়ালেও অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় তিনি পার পেয়ে যান বারবার।

২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়ে বাঁশখালী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ শুরু করেন ফোরকান। তবে সরকারি নিয়মনীতি না মেনে বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে ২০১৫ সালের ৫ জুন তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করে সিভিল সার্জন অফিস। প্রশাসনিক কাজে জটিলতা ও চাকরির বিধিমালা ভাঙার অভিযোগে কঠোরভাবে সতর্কও করা হয় তাঁকে। আচরণগত কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তাঁকে বাঁশখালী থেকে সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। সেখানেও বেশি দিন টিকতে পারেননি ফোরকান। নানা অনিয়মের কারণে পরে তাঁর ঠিকানা হয় লোহাগাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ফোরকানকে সেখান থেকেও প্রশাসনিক বদলি করা হয় চাঁদপুরে। সব শেষ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিলে সই জালিয়াতির অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে গত ১৭ জুলাই তাঁকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে বদলি করা হয়। বদলি আদেশে পাঁচ দিনের মধ্যে ছাড়পত্র নিতে বলা হয়। অন্যথায় ষষ্ঠ দিন থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন বলে গণ্য হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শামিউল ইসলামের সই করা বদলি আদেশে উল্লেখ করা হয়। আদেশের পর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিলেও এখনও হিসাব শাখার কাগজপত্র বুঝিয়ে দেননি।

বিল জালিয়াতির ঘটনায় মোহাম্মদ ফোরকানকে দায়ী করে গত ১৬ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক গঠিত তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় এর আগে গত ৩০ জুন ফোরকানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে দুদকে লিখিত অভিযোগ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, 'শাস্তি হিসেবে ফোরকানকে চট্টগ্রাম থেকে মুন্সীগঞ্জে বদলির করা হলেও সে নতুন কর্মস্থলে যোগ দেয়নি। পাসওয়ার্ড জমা দিলেও হিসাব শাখার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও জমা না দিয়ে গড়িমসি করছে। তার এমন আচরণে আমরা বিব্রত। এতে হাসপাতাল পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। কর্মস্থলে যোগদান ও কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে এ পর্যন্ত তাকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। উল্টো ফোরকান বদলি আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্যাপারটি নিয়ে সংশ্নিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এজন্য অধিদপ্তরের আইনি শাখায়ও পরামর্শ চেয়েছি। ফোরকানের অতীত রেকর্ড সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার তাকে বদলিও করা হয়েছে। '

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. সাখাওয়াত উল্ল্যাহ বলেন, 'একজন কর্মচারী হয়েও ফোরকান একের পর এক অনিয়ম করছে; অমান্য করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাও। তাকে চট্টগ্রাম থেকে কে বদলি করে তা দেখে নেবে বলেও নানাভাবে শাসাচ্ছে। সে কাউকেই পরোয়া করছে না। এটি কর্মকর্তাদের জন্য প্রেসটিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

চট্টগ্রামের সাবেক এক সিভিল সার্জন বলেন, 'ফোরকান খুবই চতুর। কর্মচারী হলেও নিজেকে অনেক বড় মনে করে সে। অনিয়মের দায়ে কয়েক বছর আগেও তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। যখনই তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে, তখনই সে নানাভাবে ওপর মহলে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে।'

জেনারেল হাসপাতালের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'অপরাধ করেও বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় ফোরকান আবারও অপরাধ-অনিয়ম করছে। তার এমন বেপরোয়া আচরণ অন্যদেরও খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ জোগাবে।'

হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে বলেন, এক ফোরকানই প্রশাসনের সবাইকে অনেকটা নাকে দড়ি লাগিয়ে ঘোরাচ্ছে। অহরহ অভিযোগের পরও ফোরকানের বিরুদ্ধে এখনও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এত বড় অপরাধের শাস্তি কেবল বদলি। তার কারণে স্বাস্থ্য প্রশাসনের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

ব্যবস্থা নিতে চিঠি: নতুন কর্মস্থলে না যাওয়া, হিসাব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নথি বুঝিয়ে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ ১০ দপ্তরে চিঠি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২২ আগস্ট পাঠানো চিঠিতে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক উল্লেখ করেন, ২৯ জুন বিল-সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে মোহাম্মদ ফোরকানের কাছে থাকা নথি ও দায়িত্ব হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ফোরকানকে বদলি নির্দেশনা দেওয়ার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় ছাড়পত্র। তবে বদলি হলেও কাগজপত্র বুঝিয়ে দেননি ফোরকান। এ কারণে ৩১ জুলাই, ৮ ও ১৬ আগস্ট তিন দফায় চিঠি দেওয়া হলেও তাঁর কাছ থেকে কোনো উত্তর মেলেনি। এর আগে গত ৪ জুলাই হিসাব শাখার চলতি দায়িত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে সব নথি বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগেও ফোরকানের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য প্রশাসনে চিঠি দেওয়া হয়।

ফোরকান যা বলছেন: অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ ফোরকান বলেন, 'বিল জালিয়াতির ঘটনায় আমি কোনোভাবেই জড়িত না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। যেসব সরঞ্জাম কেনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তো মন্ত্রণালয় বরাদ্দ ও অনুমোদন দিয়েছে। সেসব যন্ত্রপাতি এখনও হাসপাতালে ব্যবহারও করা হচ্ছে।' এই বদলি মানি না উল্লেখ করে ফোরকান বলেন, 'আমাকে অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়েছে। তাই আমি আপিল করেছি। আমি আমার অবস্থানে এখনও অনড় আছি।' তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আপনাকে বদলি করা হয়েছে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কীসের তদন্ত রিপোর্ট? তদন্ত প্রতিবেদনে আমাকে কেন দোষী করবে?'

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি অসুস্থ। সব দিক থেকে এত প্রেশার নেওয়া যায় না।' এখনও হিসাব শাখার গুরুত্বপূর্ণ নথি বুঝিয়ে দেননি এমন প্রশ্নের জবাবে ফোরকান বলেন, 'এটা মিথ্যা। আমি সব দিয়েছি।'

হুমকি-ধমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি কাউকে কখনও হুমকি দিইনি। এগুলো কর্মকর্তারা বানিয়ে বলছেন। আমি একজন শিক্ষকের ছেলে; আমার এক ভাইও সাংবাদিক ছিলেন। আপনারা আমার সঙ্গে যেসব অন্যায় হয়েছে, সেগুলো লেখেন। আমি সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। উনি সবার বিচার করবেন।'