রংপুরে যাত্রীবাহী দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন রাকিব হোসেন (৫৫)। তিনি এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ৩১নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এখন তিনি। হাসপাতালে পড়ে থাকলে সংসার চলবে কীভাবে সেই ভাবনায় তিনি এখন দিশেহারা। 

হাসপাতাল থেকে রাকিব হোসেন বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। আমি যদি অচল হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকি তবে সংসার চলবে কীভাবে। বাস চালকের কারণে আজ অনেকে জীবন হারিয়েছে, অনেকে চিরতরে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। আমি বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো চালকদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি।

একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন আব্দুর রহিম (৪৫)। তিনি বলেন, কোনকিছু বোঝার আগেই বাসে সজোরে ধাক্কা লাগে। এতে আমি অচেতন হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে গেছে।    

রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটা এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই নিহত হন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঝাকুয়াপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৩৫), সয়ার কাজীপাড়া গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আনিছার রহমান (৪৮), নীলফামারী সৈয়দপুর কুন্দল পূর্বপাড়া গ্রামের মহসিন আলী সাগর (৪২) ও অজ্ঞাত আরও দুই জন। 

দুর্ঘটনাকবলিত দুটি বাস। ছবি: সমকাল

আর রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নীলফামারী সৈয়দপুরের নুর হোসেন আরিফ বিল্লাহ (৩৩), তারাগঞ্জ পলাশবাড়ির বিনোদ রায়ের ছেলে ধনঞ্জয় (৪৫), সৈয়দপুর কামারপুরের রায়হান মিয়ার ছেলে জুয়েল রায়হান (২৭) ও ঢাকা সাভারের বাসিন্দা দুর্ঘটনা কবলিত একটি বাসের অজ্ঞাতনামা হেলপার। এছাড়া এতে আহত হয়েছেন ৬২ জন বাসযাত্রী। তারা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে দুই জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।  

এদিকে সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল মিয়াকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গোলাম রব্বানী।

যেভাবে ঘটলো এই দুর্ঘটনা

পুলিশ, আহত যাত্রী ও স্থানীয়রা জানায়, রোববার রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থেকে ইসলাম পরিবহনের একটি বাসা (ঢাকা মেট্রো-ব ১৫-৯৩১৪) ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। অপরদিকে রংপুর থেকে জোহানা পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৫০২১) ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে যাচ্ছিল। রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের তারাগঞ্জ খারুভাজ সেতুর কাছে আসলে বাস দুটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই বাসের ৫ যাত্রীর মৃত্যু হয় এবং আহত হন প্রায় ৭০ জন যাত্রী। 

খবর পেয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় এলাকাবাসী উদ্ধার কার্যক্রমে নেমে পড়েন। আহতদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ তারাগঞ্জ হাইওয়ে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

ইসলাম পরিবহনের একাধিক আহত যাত্রী জানান, ভারী বৃষ্টির কারণে রাতের রাস্তায় সামনে বেশিদূর দেখা যাচ্ছিল না। এ ছাড়া বৃষ্টি ও জনমানব শূন্য রাস্তায় চালক বেপরোয়া গতিতে বাসটি চালাচ্ছিলেন। এ নিয়ে কয়েকজন যাত্রী প্রতিবাদও করেছিলেন, কিন্তু চালক তাতে কান দেননি। 

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন আহত এক ব্যক্তি। ছবি: সমকাল

শুধু তাই নয় যাত্রীদের অভিযোগ, চালক গাঁজা ধরিয়ে দ্রুত গতিতে বাসটি চালাচ্ছিলেন। গাঁজা ধরানোর ৭ থেকে ৮ মিনিটের মাথায় ইসলাম পরিবহন বামদিকে থাকা একটি ট্রাককে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। এ সময় বিপরীত দিক থেকে জোহানা পরিবহনের বাসটি আসছিল। ইসলাম পরিবহনের চালক ওভারটেক করবে কি না তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বাস দুটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। 

হাসপাতালে নিহত-আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড়

রোববার মধ্যরাতেই আহত ব্যক্তিদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আহত রোগীরা হাসপাতালে আসা শুরু করলে রোগীর স্বজনদের ভিড় বাড়তে থাকে।  আহতদের সার্জারি, নিউরো সার্জারি, অর্থপেডিক্স বিভাগে ভর্তি করা হয়। রোগীর চাপ বাড়ার কারণে হাসপাতালের ফ্লোরেই বেশিরভাগ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহত ব্যক্তিরা রংপুর, নীলফামারী ঠাকুরগাঁও এবং পাবনা জেলার বাসিন্দা। 

রংপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতে অসর্তকতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোকে এ দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরেছি। দুর্ঘটনার পর গাড়ি চালকদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। 

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরিফুল হাসান বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমরা ৪ জনকে হারিয়েছি। বর্তমানে হাসপাতালের সার্জারি, নিউরো সার্জারি, অর্থপেডিক্স বিভাগে ৬২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল প্রশাসন তৎপর রয়েছে। আমরা আহত রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়ে তাদের দ্রুত সুস্থ করে তুলবো।     

প্রশাসনের তৎপরতা 

সোমবার সকালে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ। তারা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও চিকিৎসাধীন রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান।

দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ছবি: সমকাল

রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের দাফনের জন্য পরিবারের সদস্যদের ২০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে। যারা উপজেলা কিংবা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারি যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা দেওয়া হচ্ছে। যদি সরকারি অনুদানের প্রয়োজন হয়, আমরা সেটি দিতেও প্রস্তুত। 

এ ছাড়া বেশি সংকটাপন্ন রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য যদি ঢাকা পাঠানোর প্রয়োজন হয়, সেলক্ষ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর কিংবা হাসপাতালের মাধ্যমে সেই রোগীকে ঢাকায় পাঠাতে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি। 

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ বলেন, রোববার রাতে দুটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংর্ঘষে ঘটনাস্থলে ৫ জন ও হাসপাতালে ৪ জন যাত্রী মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি করা হবে।  বেপরোয়া গতিতে বাস চালানো নাকি অন্য কোনো কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।