নাম দুর্গাসাগর হলেও এটি আসলে সাগর নয়। নয় কোনো নদী ও হ্রদও। প্রায় আড়াইশ বছর আগে বরিশাল নগরীর অদূরে খনন করা এই দিঘিটির সৌন্দর্য দিন দিনই বাড়ছে। তাই বাড়ছে পর্যটকও।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি গ্রামের জহিরুল ইসলাম ও রুবিনা আক্তার দম্পতি বেড়াতে এসেছিলেন দুর্গাসাগরে। জহিরুল বলেন, 'এখানে এলে মন ভরে যায়। চারদিকে সবুজে ঘেরা। পাখ-পাখালির কলরব আর দুর্গাসাগরের অথৈ স্বচ্ছ পানির শোভা মুগ্ধ করে সবাইকে।' রুবিনা আক্তারের মত, 'দুর্গাসাগর দিঘি হলেও এখানে এলে সাগরের পরশ পাই।'
সম্প্রতি এক বিকেলে দুর্গাসাগর ভ্রমণে এসেছিলেন বরিশাল নগরীর কাউনিয়ার তরুণ সায়েম ইসলাম। বললেন, 'প্রকৃতির মনোরম পরশ পেতে সময় পেলেই আমরা দুর্গাসাগরে আসি। দুর্গাসাগর দিঘি হলেও সাগরের মতো দেখতে। চারদিকে চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাই বারবার মন এখানে চলে আসি।
দুর্গাসাগরে ঢুকতেই দেখা মেলে হরিণ ও ময়ূরের। চারপাশে বিপুল সবুজ বৃক্ষের সমাহারে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখিকুলের কলকাকলিতে মনে হবে প্রকৃতি তার রূপের ডানা মেলে দিয়েছে।

বরিশাল নগরী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা গ্রামে অবস্থিত দুর্গাসাগর। মাধবপাশা ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সর্বশেষ রাজধানী। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ তাঁর স্ত্রী দুর্গা রানীর নামে খনন করেন এক বিশাল জলাধার। নাম দেওয়া হয় 'দুর্গাসাগর'।
সেই রাজ্য নেই, রাজাও নেই। তবে দুর্গাসাগর দিঘিটি এখনও জীবন্ত হয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য এবং রাজাদের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯৬ সালে একে 'দুর্গাসাগর দিঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য' প্রকল্পের আওতায় এনে পরিণত করা হয়েছে এ অঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে। দিঘিটি এখন তত্ত্বাবধান করছে বরিশাল জেলা প্রশাসন।
বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দুর্গাসাগরকে দর্শনার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করতে একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। বরিশাল গণপূর্ত দপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দুর্গাসাগরের অভ্যন্তরে একটি রেস্ট হাউস, বিপণিবিতান, বোট ল্যান্ডিং স্টেশন, ওয়াকওয়ে, দৃষ্টিনন্দন ঘাটলা, সিটিং বেঞ্চ, সীমানাপ্রাচীরসহ প্রায় ২৫টি উন্নয়নকাজ চলছে। এসব কাজের ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে।

দুর্গাসাগর দিঘি ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো ঘাটলাগুলো টাইলস দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। দিঘির পানিতে আপনমনে ভেসে বেড়াচ্ছে শতাধিক দেশি ও রাজহাস। চারপাশে পর্যটকদের বসার জন্য আছে পর্যাপ্ত বেঞ্চ। পিকনিক শেড ও সাংস্কৃতিক মঞ্চ করা হয়েছে আরও চার বছর আগে। দিঘির দক্ষিণ পাড়ে নির্মিত হয়েছে 'আর্ট ফুড' রেস্তোরাঁ। পশ্চিম পাড়ে নির্মিত মিনি শিশুপার্কে ঘুরতে আসা শিশুরা আনন্দে মেতে থাকে সারাক্ষণ। খাঁচার মধ্যে ঘুরে বেড়ায় ইমু ও ঘুঘু পাখির দল। কবুতর আছে শত শত। প্রতিবছরই দিঘির চারপাশে বিপুলসংখ্যক ফলদ ও বনজ বৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়।

সপরিবারে দুর্গাসাগর দিঘিতে বেড়াতে আসা বরিশাল নগরীর শাহ পরান সড়কের বাসিন্দা খান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, প্রকৃতির মনোরম পরশ পেতে দুর্গাসাগর ভ্রমণের বিকল্প নেই। দিঘির পাড়ে হরিণ ও বানরের বিচরণ এবং নানা প্রজাতির পাখির কলরব শিশু-কিশোরসহ সব দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে। সব বয়সী মানুষের জন্য দুর্গাসাগর চমৎকার দর্শনীয় স্থান।
জেলা প্রশাসনের উন্নয়ন ও নজরদারিতে সারা বছরই প্রচুর দর্শনার্থী যান দুর্গাসাগর দিঘি ভ্রমণে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বনভোজন এবং প্রকৃতিপ্রেমীর ঢল নামে ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘির চারপাশে। দুর্গাসাগর দিঘি দেখভালের দায়িত্বে থাকা বরিশাল জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গৌতম বাড়ৈ বলেন, শুক্র ও শনিবার প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। এ ছাড়া প্রতিদিনই কমবেশি পর্যটক যান দুর্গাসাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে দুর্গাসাগর দিঘি বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।

প্রথম খননের ১৯৪ বছর পর ১৯৭৪ সালে দিঘিটি পুনর্খনন করা হয়। তখন দিঘির মাঝখানে একটি দ্বীপ তৈরি করা হয়। ১৯৯৬ সালে দুর্গাসাগর দিঘিকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। দুর্গাসাগর দিঘির মোট আয়তন ৪৫ দশমিক ৫৫ একর। দিঘিটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৫০ এবং ৭৫০ ফুট।