
ছোট বারইহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ভবনের দুই কক্ষ সংস্কারের নামে কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে - সমকাল
গফরগাঁওয়ে চলতি অর্থবছরে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারে সরকারি বরাদ্দের সিংহভাগ লুটপাট হয়েছে। দায়িত্বরতরা কাজ না করেই কৌশলে প্রায় কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ।
করোনা মহামারির কারণে দুই বছর অ্যাডহক কমিটি দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হতো। গত ৩১ মার্চ অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর এপ্রিল মাসে প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির তালিকা জমা নেয় উপজেলা শিক্ষা অফিস। নিয়ম অনুযায়ী, তালিকা জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই কমিটি অনুমোদনের কথা। অথচ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের আহ্বায়ক করে আবারও অ্যাডহক কমিটি করা হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি না থাকায় উন্নয়ন কাজের টাকা লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। উপজেলা প্রকৌশল অফিস প্রকল্প কাজের প্রাক্কলন তৈরি করে বিদ্যালয়ের দৃশ্যমান জায়গায় ঝুলিয়ে রাখবে। তবে সরেজমিনে কোনো বিদ্যালয়ে প্রকল্পের তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজ শেষে সামাজিক মূল্যায়ন কমিটি (এসএমসি) এবং সামাজিক নিরীক্ষা কমিটির (এসএসি) প্রত্যয়নপত্র দিলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্ত শেষে বিল দেবেন। কিন্তু এ নিয়মও মানা হয়নি।
দাওয়াদাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি টয়লেট চার বছর ধরে পরিত্যক্ত। নলকূপ নেই দুই বছর। প্রাকৃতিক কাজে পাশের বাড়ি যান শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন হলে পাশের জঙ্গলে যেতে বলেন শিক্ষকরা। সম্প্রতি এক ছাত্রী লজ্জায় বলতে না পাড়ায় শ্রেণিকক্ষেই কাপড় নষ্ট করে ফেলে। এ সময় ওই শ্রেণিকক্ষেই ছিলেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সবুজ মিয়া। অথচ বিদ্যালয়টিতে চলতি বছরও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে ২ লাখ, স্লিপের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। গত ৮ আগস্ট এসব তথ্য দেন একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তখন ছিলেন না প্রধান শিক্ষক।
কী কী উন্নয়ন কাজ করেছেন- জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়ের সামনে এক ধাপ সিঁড়ি নির্মাণ, দুটি জানালা পরিবর্তন ও বারান্দার কয়েকটি টিন পাল্টানো হয়েছে। টয়লেট ও নলকূপ সংস্কারে কত টাকা লাগতে পারে, প্রশ্নে তিনি বলেন, ১৫-২০ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক শিল্পী খানমের ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
একই দিনে ছোট বারইহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, চলতি বছর বিদ্যালয়টির উন্নয়নে দুটি প্রকল্পে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা খুঁজে না পেলেও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আফতাবুন নাহার রোজী জানান, বারন্দায় গ্রিল, পুরোনো ভবনের দুটি কক্ষের টিনের চালা মেরামত, দরজা-জানালা মেরামত ও রঙের কাজ করা হয়েছে। কাজ শেষে বিলও তোলা হয়েছে। তবে দেখা গেছে, শুধু রং করা এবং বারান্দার গ্রিল লাগানো হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে বলে জানান প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের সদস্য আলী আযম খান। কাজ না করে টাকা তোলার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, 'সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুশল আহম্মেদ রনি ও একজন সহকারী শিক্ষকের সমন্বয়ে কাজ শেষে অতিরিক্ত টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়।'
উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুশল আহম্মেদ রনির ভাষ্য, কাজ এখনও চলছে। কাজ শেষ করার আগে বিল দিলেন কেন, প্রশ্নে তিনি বলেন, টাকা আটকে রাখলে শিক্ষা অফিসের বদনাম হয়।
কেল্লারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও দুটি উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ও স্লিপের ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনুমোদিত প্রকল্পের তালিকা এবং প্রাক্কলনের প্রমাণপত্র দেখতে চাইলে সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন তা দেখাতে পারেননি। ওই দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন প্রধান শিক্ষক রাহিমা সরকার। ফোনে তিনি বলেন, প্রকল্প গ্রহণের কোনো প্রমাণপত্র বিদ্যালয়ে নেই। তবে বারান্দায় গ্রিল, ছাদ ও কক্ষ সংস্কার ও তিনটি ফ্যান লাগানো হয়েছে।
বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকার কাজ হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, বিনামূল্যে বিতরণের খাতা শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি, বিদ্যালয়ের ল্যাপটপ গায়েব ও ১০টি বেঞ্চ বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে ২০ টাকা করে খাতা কেনার কথা স্বীকার করেছে তৃতীয় শ্রেণি ও চতুর্থ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী।
সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুশল আহম্মেদ রনি বলেন, খাতা বিক্রির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষক রাহিমা সরকার স্থানীয় দুই ইউপি চেয়ারম্যানের সামনে মাফ চেয়েছেন।
গত ৮ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পাতলাসী পশ্চিমপাড়া নায়েব আলী প্রধান, বারইহাটি-২, আমাতুরের টেক, ভরপুর, টাঙ্গাবর দক্ষিণপাড়া, টাঙ্গাবর, চান্দপুর, মৃধাবাড়ি, আঙ্গাড়ি, বড় বড়াই, ডুবাইল, মেদনারটেক ইউসুফ আলী, আঙ্গারি-২, বারইহাটি, চরমছলন্দ কান্দাপাড়া, চরমছলন্দ কিনারআলগী ও চরমছলন্দ মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে কোনো প্রকল্পের তালিকা ও ভাউচার পাওয়া যায়নি।
শিক্ষা অফিস থেকে জানা যায়, উন্নয়ন কাজে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৭১টি স্কুলে ২ লাখ টাকা করে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ২৩৮টি স্কুলে স্লিপের ১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ১১৬টি স্কুলে রুটিন মেরামতে ৪৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা যায়, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সাইফুল মালিক বলেন, প্রত্যেক বিদ্যালয়েই প্রকল্পের তালিকা এবং ভাউচার থাকার কথা। দৃশ্যমান জায়গায় প্রকল্পের তালিকা না টানানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি নীরব থাকেন। প্রত্যয়নপত্র ছাড়া বিল দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির তালিকা জমা হওয়ার পর কেন অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে, জবাবে তিনি বলেন, কমিটি নিয়ে জটিলতার কারণে করতে হয়েছে।
মন্তব্য করুন