- সারাদেশ
- ছাত্রলীগের ১৮ নেতার কাছে জিম্মি ২৮ হাজার শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রলীগের ১৮ নেতার কাছে জিম্মি ২৮ হাজার শিক্ষার্থী

ছবি: ফাইল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়। পাঁচ বছরের কোর্স তিনি শেষ করেননি ১১ বছরেও। পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকলেও খুন, মারামারি, হল দখলে বেশ সিদ্ধহস্ত তিনি। তার বিরুদ্ধে আছে খুনের মামলাও। জামিনে থেকেই এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। চবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি পদে স্থান পাওয়া তাঁকে এই সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি 'ভাসির্টি এক্সপ্রেস' নামে বগিভিত্তিক একটি গ্রুপেরও নেতৃত্বে আছেন।
প্রদীপের মতো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ১৮ নেতা এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছেন এ ক্যাম্পাসে। তাঁরা যখন ইচ্ছে অবরোধ ডাকেন, টায়ার জ্বালিয়ে প্রধান ফটকে দেন তালা মেরে। তাঁদের নির্দেশে বন্ধ করে দিতে হয় ক্লাসরুম। পরীক্ষাও স্থগিত করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। চবি অচল করতে ইচ্ছে হলেই তাঁরা বন্ধ রাখেন শাটল ট্রেন। মন চাইলে অপহরণ করেন শাটল ট্রেনের চালককে। তাঁদের ভয়ে তটস্থ থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নানা অপরাধে জড়িত এই ১৮ নেতা আবার গুরু মানেন আওয়ামী লীগের দুই বড় নেতাকে। তাঁদের একজন হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। অন্যজন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তবে দুই নেতা অবশ্য প্রকাশ্যে এমন অনুসারী থাকার কথা স্বীকার করেন না। চবির রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এসব ছাত্রনেতার ইচ্ছার কাছে জিম্মি ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। তাদের বিরুদ্ধে এবার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী গাদ্দাফী কুহু বলেন, 'করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে গেছি আমরা। এখন আবার যে যার ইচ্ছামতো অচল করে দিচ্ছে চবি। এভাবে চলতে থাকলে সেশনজট আরও বাড়বে।'
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের অবরোধ, আন্দোলন ও বিক্ষোভে চবি বারবার আসছে শিরোনামে। কখনও পদের জন্য, কখনও হল দখল, কখনও বা অন্তর্কোন্দলে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। পান থেকে চুন খসলেই তারা লিপ্ত হচ্ছে মারামারিতে। আগে পদের জন্য এমন সংঘর্ষে জড়াত রেজাউল হক রুবেল ও ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারীরা।
তখন মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল খুনের মামলার আসামি রাজু মুন্সী, টেন্ডারবাজ নাছির উদ্দীন সুমন, ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিস্কার সাঈদুল ইসলাম, শামসুজ্জামান সম্রাট ও হল দখলদার মোহাম্মদ ইলিয়াস। পদ পাওয়ার পর তারা কিছুটা নীরব হলেও শান্তি ফেরেনি ক্যাম্পাসে।
চবি এখন অচল করে দিচ্ছেন অন্য সাত উপগ্রুপের ১৩ জন। এর মধ্যে আছেন রকিবুল হাসান দিনার, আবু বকর তোহা, প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়, রায়হান রেজা, আবরার শাহরিয়ার, নিজাম উদ্দীন রবিন, শরীফ হোসেন, সুমন খান, দেলোয়ার হোসেন, সাজ্জাদ আনাম পিনন, নয়ন চন্দ্র মোদক, সাখাওয়াত এবং ওয়াহিদুল ইসলাম। তাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থী। ৬ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আছেন তাঁরা। ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স), বাংলার মুখ, রেড সিগন্যাল, কনকর্ড, এপিটাফ, উল্ক্কা ও বিজয়ের শীর্ষ নেতা হিসেবে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। বগিভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ করে ছাত্রলীগের মূল কমিটিকেই বেকায়দায় রেখেছেন তাঁরা। গত দেড় মাসেই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় অচল করেছেন দু'বার। নবগঠিত কমিটির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও সংগঠনবিরোধী কাজ করার অভিযোগ এনে দু'দিন আগেও অবরোধ করেন তাঁরা চবি।
কমিটি সম্প্রসারণের দাবিতে চবিতে সর্বশেষ অবরোধ হয়েছে গত সোমবার। এতে ১১টি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউটের শতাধিক ক্লাস। এর দেড় মাস আগে আরেক দফা অবরোধে স্থগিত হয় ৯টি বিভাগের ১১টি শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা। মাত্র ১৩ জন নেতার কথায় তাঁদের ৫০-৬০ জন অনুসারী অচল করে দিচ্ছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়।
বারবার অবরোধ দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করা প্রসঙ্গে প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, 'কমিটিতে যোগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করার ন্যায্য দাবি না মানায় আমাদের বাধ্য হয়ে অবরোধে যেতে হয়েছে।' নিজের নামে মামলার বিষয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, 'এটি রাজনৈতিক মামলা। যারা রাজনীতি করে, তাদের নামে মামলা থাকবেই। বঙ্গবন্ধুর নামেও মামলা ছিল। তবে আমি এই মামলার স্থায়ী জামিনে আছি।'
আবরার শাহরিয়ার বলেন, 'রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে অবরোধ ডাকছি আমরা। এর সুফল এক দিন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও পাবে।' নয়ন চন্দ্র বলেন, 'পদবঞ্চিত নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত, পদধারী নেতাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন এবং বিবাহিত, চাকরিজীবী ও মাদক ব্যবসায়ী নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে আছি আমরা।'
তবে চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, 'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তিন হাজার নেতাকর্মী আছে। সবাইকে তো নেতা বানানো সম্ভব নয়।' সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, 'নেতা হওয়ার জন্য কারও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, এটি ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাস।'
মন্তব্য করুন