- সারাদেশ
- দরিদ্র শাওনের প্রাণ নিল সংঘাতের রাজনীতি
দরিদ্র শাওনের প্রাণ নিল সংঘাতের রাজনীতি

ফাইল ছবি
একটি জরাজীর্ণ টিনের ঘর। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বড়োজোর ১০ ফুট করে হতে পারে। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির সমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত যুবদল কর্মী শহিদুল ইসলাম শাওনের বাড়ির চিত্র এটি। রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারানোর তালিকায় সর্বশেষ নাম যোগ হওয়া ২২-২৩ বছর বয়সী এ অতিদরিদ্র তরুণ জীবন নির্বাহের জন্য অটোরিকশা চালাতেন। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, আট মাস বয়সী দুধের ছেলে আর মা-বাবাকে। তাঁদের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার।
মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা মহল্লায় শাওনের বাড়ি। তাঁর পাশের আত্মীয়দের বাড়িঘরগুলো বেশ উন্নত। শাওন ঢাকায় কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। মাস ছয়েক আগে এলাকায় আসেন। শাওনের শ্বশুর মো. শহীদুল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি জানালেন, বছর দুই আগে তাঁর মেয়ের বিয়ে হয় শাওনের সঙ্গে। শাওনের বাবা সওয়াব আলী ভূঁইয়াও অটোরিকশা চালান। বাবা-ছেলের রোজগারে সংসার চলে। শাওনের আরও দুটি ছোট ভাই এবং এক বোন আছে।
শুক্রবার বিকেলে শাওনদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, পাড়া-প্রতিবেশী নারীদের ভিড়। রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হওয়ায় পুলিশের ঝামেলার আশঙ্কায় পুরুষ আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা আসেননি। শাওনকে মিরকাদিম পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক বলে দাবি করলেও স্থানীয় বিএনপি নেতাদেরও দেখা যায়নি তাঁর বাড়িতে। মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে স্থানীয় নেতারা এলাকাছাড়া।
অবশ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এলে দলের কয়েকজন স্থানীয় নেতা শাওনের বাড়িতে যান। শাওন যুবদলের পদধারী নেতা ছিলেন কিনা, তা নিশ্চিত হতে পারেনি সমকাল। তবে তিনি বিএনপির কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন বলে জানিয়েছেন তাঁর প্রতিবেশীরা। রিজভী জানান, শাওনের পরিবারের দায়িত্ব এখন থেকে বিএনপির।
তাঁর এক চাচাতো ভাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি-পাগল ছিল শাওন। কিন্তু তাঁর পদপদবি ছিল কিনা জানেন না। তিনি শ্রমিকের কাজকর্ম করতেন। কয়েক মাস আগে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। শাওনের ছোট ভাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন।
বুধবার মুন্সীগঞ্জে সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর শাওনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে শাওনের মরদেহ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন স্বজনরা। দিনের বেলায় পুলিশ না থাকলেও মরদেহ আনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর বাড়িতে আসেন। তবে জানাজা বা দাফনে বাধা দেননি।
সংঘর্ষের মামলায় গতকাল শুক্রবার কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। পুরাতন ফেরিঘাটে সংঘর্ষের ঘটনায় শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মালেকের মামলায় শাওনকে তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে। একই সংঘর্ষে গুরুতর আহত জাহাঙ্গীর ফকিরের বাড়ি চর কেওয়ার ইউনিয়নের গুহের কান্দি গ্রামে। তাঁর পরিবারও অতিদরিদ্র।
প্রতিবেশীরা জানান, সৎমা লিপি বেগম শাওনকে এক বছর বয়স থেকে লালন-পালন করেছেন। পুত্রশোকে জরাজীর্ণ ঘরটির জানালা ধরে অঝোরে কাঁদছিলেন। বারবার অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। তিনি আহাজারি করে বলেন, তাঁর ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পুলিশ। ছেলে হত্যার বিচার চান তিনি।
শাওনের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তাঁর বাবা শহীদুল জানালেন, নাতি হওয়ার পর থেকে মেয়ে তাঁর কাছেই ছিল। শাওন কয়েকদিন আগে জানান, স্ত্রী-সন্তানকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসবেন। জামাতার আহত হওয়ার খবরে বুধবার রাতে মেয়েকে নিয়ে শাওনের বাড়িতে আসেন। শহীদুল জানালেন, মামলার বিচার নিয়ে ভাবছেন না। বাবাহারা নাতির কী হবে, তাই নিয়ে এখন তাঁদের যত চিন্তা।
প্রতিবেশীদের সবাই শাওনের আট মাস বয়সী শিশুসন্তানকে নিয়ে আফসোস করছিলেন। একজন বললেন, এই ছেলের ভবিষ্যৎ কী? শাওনের শ্যালক জানালেন, একটু ঘুরতে যাচ্ছেন বলে বুধবার দুপুরে বাড়ি থেকে বের হন তাঁর দুলাভাই। এরপর কার ডাকে বিএনপির সমাবেশে গিয়েছিলেন, তা জানেন না।
সেদিন মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত শাওনকে বিএনপি কর্মীরা উদ্ধার করেন। তাঁকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলের কর্মীরা। পরে সন্ধ্যায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাড়িতে আনা হয়। সেখানে জানাজা শেষে রাত ১১টার দিকে স্থানীয় একটি কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করার কথা।
মন্তব্য করুন