- সারাদেশ
- সুন্দরবনে বিষে ভাসছে মাছ
সুন্দরবনে বিষে ভাসছে মাছ

সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সময় ১৩ সেপ্টেম্বর ৮ জেলেকে আটক করে বন প্রহরীরা-সমকাল
সুন্দরবনের গহিনের বিভিন্ন নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা কিছুতেই থামছে না। সম্প্রতি বনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই ভেসে উঠছে মরা মাছ।
বনের চাঁদপাই রেঞ্জের শুয়ারমারা ও কাটাখালী খালের পানিতে গত সপ্তাহে বিভিন্ন প্রজাতির মরা মাছ ভাসতে দেখেন বনরক্ষী ও স্থানীয়রা। এ ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি। এ অবস্থায় ম্যানগ্রোভ বনের মৎস্য সম্পদসহ বনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ম্যানগ্রোভ এ বনের নদী ও খাল নানা প্রজাতির মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত।
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর (২০২১ সালে) সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের বনরক্ষী, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী অপরাধী চক্রের অন্তত ১৮ থেকে ২০টি চালান জব্দ করেন। এ সময় আটক হয় চক্রের সক্রিয় দুই ডজনের বেশি সদস্য।
জব্দ হয় তাঁদের ব্যবহূত নৌকা-ট্রলার, জাল, তরল ও পাউডার বিষ, বিষ দিয়ে আহরিত মাছ, হরিণের মাংস, চামড়াসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আটক হয়েছে চক্রের ১১ সদস্য। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মৎস্য প্রজনন মৌসুমে তিন মাস বন্ধ রাখা হয় মৎস্য আহরণসহ পর্যটন। গত ১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন উন্মুক্ত হলে শুরু হয় পর্যটনসহ মৎস্য আহরণ মৌসুম। মৌসুম শুরু হতে না হতেই ১৩ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের হারবাড়িয়া এলাকা থেকে বিষ প্রয়োগকারী চক্রের আট সদস্যকে আটক করে বন বিভাগ। তাঁদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় চারটি জাল, তিনটি নৌকা, ব্যবহার নিষিদ্ধ কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগে আহরিত মাছ।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান জানান, গত সপ্তাহে গোপনে ঢুকে বনের উলুবুনিয়া খালের নলবুনিয়া এলাকায় বিষ দেয় একদল দুর্বৃত্ত। বিষে খালের ওই এলাকায় মরা ট্যাংরা, দাতিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভাসতে দেখা যায়।
বন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, এ চক্রের মূল হোতা আলমগীর ওরফে খোকনকে শনাক্ত করা হয়েছে। খোকন বনসংলগ্ন হোগলাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকেসহ তাঁর সহযোগীদের ধরতে বন বিভাগের তৎপরতা চলছে। বনের অভ্যন্তরে মৎস্য দুর্বৃত্ত চক্রের আনাগোনা এবং প্রবণতা বৃদ্ধিতে চরম হতাশার মধ্যে স্থানীয় সাধারণ জেলে ও পেশাজীবীরা।
এ প্রসঙ্গে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শহিদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, বনকেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের তৎপরতা দমনে নানা কৌশলসহ কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, সুন্দরবনের শুয়ারমারা ও কাটাখালী এলাকায় খালের পানিতে মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনা তদন্তে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নির্দেশনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন- চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান, জোংড়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ও বনরক্ষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান।
সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবণতা প্রসঙ্গে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বনের জলাভূমিতে কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগের কারণে মাছের প্রজননসহ জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। আর বিষাক্ত মাছ খেয়ে পাখি এবং পানি পানে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বনের অন্য প্রাণীরা। এতে প্রাণিকুলের অস্তিত্ব, মৎস্য সম্পদ ও বনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় যুগোপযোগী পদক্ষেপসহ বন বিভাগের জনবল ও আধুনিক জলযান জরুরি। একই সঙ্গে বন আইনের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এ পরিবেশবিদ।
সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগে মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, পৃথিবীর একক এ ম্যানগ্রোভ বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য, প্রাণিকুলসহ অফুরন্ত সম্পদ সুরক্ষায় অনুপ্রবেশকারী চক্রের আগ্রাসন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায় মাছর প্রজনন ও নার্সারি গ্রাউন্ড খ্যাত সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ অচিরে হুমকির মুখে পড়বে। এ খাতে জড়িত সাধারণ পেশাজীবী জেলেরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় পড়বেন।
মন্তব্য করুন