- সারাদেশ
- বগুড়ার ভেজাল সারে কৃষির সর্বনাশ
বগুড়ার ভেজাল সারে কৃষির সর্বনাশ
পুলিশি অভিযানে নকল দস্তা কারখানা সিলগালা

বগুড়ায় তৈরি ভেজাল সারে হুমকিতে পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষিজমি ও শস্যভান্ডার। কমে যাচ্ছে মাটির উর্বরতা, বাড়ছে কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি। পচা শেওলা, ডিনামাইট পাউডার, পোড়ামাটি, শামুক ও পাথর কুচির সঙ্গে রং মিশিয়ে বাধাহীনভাবেই তৈরি করা হচ্ছে এসব ভেজাল সার। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে ফেলার মতো উপাদান মিশিয়ে কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল দস্তা, জিঙ্ক, টিএসপি ও এমওপি সার। পরে এগুলো বগুড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে।
গতকাল মঙ্গলবার বগুড়ার কাহালুতে ভেজাল সার তৈরি করায় অনুমোদনহীন আনিকা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি সার তৈরি কারখানা সিলগালা করে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় কারখানার মালিক জাকির হোসেনকে সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল নাইমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত সেখানে অভিযান চালান।
অভিযানকালে সার তৈরির কাঁচামাল ২৫ কেজি ওজনের ১ হাজার ৬২০ বস্তা এবং সার ৫০ কেজি ওজনের ২৫ বস্তা, ৫০ লিটারের ২৬টি অ্যাসিডভর্তি ড্রাম এবং ৪৭০টি খালি ড্রাম জব্দ করা হয়। এখানে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে ভেজাল দস্তা সার তৈরি করে দীর্ঘদিন থেকে বাজারজাত করা হচ্ছিল। বিএসটিআই বগুড়া কার্যালয়ের পরিদর্শন কর্মকর্তা (সিএম উইং) প্রকৌশলী জুনায়েদ আহমেদ ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাকিব হাসান জানান, পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এগুলো ভেজাল সার।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল নাইম বলেন, কারখানার মালিকের পক্ষে ব্যবস্থাপক জরিমানার টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপর কারখানাটি সিলগালা করা হয়।
কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, নিয়মিত তদারকি করেও ভেজাল সার উৎপাদন বন্ধ করতে পারছেন না তাঁরা। নকল সার তৈরির অভিযোগে কয়েকবার বেশ কয়েকটি কারখানা সিলগালা করা হয়েছে। দায়ীদের নামে মামলা করা হয়েছে। তবুও গোপনে নকল সার তৈরি করা হচ্ছে।
বগুড়া কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, জেলায় ছোট-বড় শতাধিক দস্তা সার উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধন আছে হাতেগোনা কয়েকটির। ২০১৮ সালের শেষের দিক থেকে এই অঞ্চলে সার ভেজাল তৈরি করার প্রবণতা দেখা যায় বেশি। এ ছাড়া একটি চক্রের সদস্যরা দেশি-বিদেশি নামিদামি কোম্পানির নকল প্যাকেটে ভেজাল সার ভরে বড় বড় দোকানে বিক্রি করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাথরের কুচি, ডিনামাইট পাউডার, পোড়া মাটি, শামুকের কুচিসহ জমির জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন পদার্থের সঙ্গে রং দিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল সার। কারখানার মালিকরা স্থানীয় লোকজনের চোখ এড়াতে রাতের আঁধারে ও দিনের সুবিধাজনক সময়ে নানা কৌশলে এসব কারবার করে। পরে বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হয়। ভারত, চীন ও কোরিয়া থেকে আমদানি করা উন্নতমানের সার বলে সর্বোচ্চ দরে কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয় এ নকল সার।
বগুড়ায় রয়েছে শতাধিক বড় আকারের কীটনাশক রিপ্যাকিং ও বিপণন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বগুড়া সদরে ৫০টি কৃষি বিভাগের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে রাসায়নিক আমদানি করে স্থানীয়ভাবে সেগুলো রিপ্যাকিং ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে। হাতেগোনা দু-চারটা প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে এই কাজগুলো করলেও বেশির ভাগই অবৈধ। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের উদ্যোক্তাই বিভিন্ন নামিদামি কীটনাশক কোম্পানিতে কর্মরত।
বগুড়া সদর উপজেলার শেখেরকোলা গ্রামের কৃষক আবদুস কুদ্দুস বলেন, এসব ভেজাল সার চোখে দেখে বোঝা যায় না। জমিতে দেওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে ফসল দ্রুত বাড়ে। এরপর জমিতে ছোট ছোট শামুক ও পিঁপড়া হয়। জমির মাটি কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক দিন পর ফসলের গোড়া পচে গাছ মরে যায়। এ ছাড়া এই সার ব্যবহার করে অনেকর হাতে ও শরীরে ঘা হচ্ছে।
এর আগে শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের মহিপুর কলোনি গ্রামের নকল সার কারখানার খোঁজ মেলে। সেখান থেকে ৩০ বস্তা ভেজাল সার, ৫০ কেজি রং, ১৫টি কোম্পানির প্যাকেটের নকল লেভেল, স্প্রে মেশিন, মাটি ও ইটের খোয়ার বস্তা জব্দ করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা কীটনাশক উৎপাদক সংস্থার সভাপতি দীলিপ কুমার বলেন, বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। কারণ, এই অনুমতি তারাই দিয়ে থাকে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক দুলাল হোসেন বলেন, ঢাকার খামারবাড়ির অফিস থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে স্থানীয়ভাবে দায়িত্বশীল কৃষি কর্মকর্তারাও সুপারভিশন করে থাকেন। নজরদারি রাখা হচ্ছে, তারপরও আমরা কৃষককে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।
বগুড়া মৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষক আমিনুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই কৃষিজমিতে একাধিক ফসল উৎপাদিত হচ্ছে, এতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া হাইব্রিড ফসল উৎপাদনেও বেশি বেশি সার প্র্রয়োগ করতে হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা। এর মধ্যে আবার ভেজাল সার প্রয়োগে মাটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
মন্তব্য করুন