নেত্রকোনা থেকে সড়কপথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দূরত্ব ১৫৫ কিলোমিটার। এই দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দেবেন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ব্যস্ত মহাসড়কে তাঁর সঙ্গী সাদাছড়ি। জীবনের মায়া ত্যাগ করেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আশায় পদযাত্রা করছেন নেত্রকোনার মো. হাবিবুর রহমান। প্রতিবন্ধীদের জন্য গড়ে তোলা দেশের সব বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করার দাবি জানাবেন তিনি। সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়, মন্ত্রীর দপ্তর ঘুরে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে সমাধান চাইতে তিনি ছুটে চলেছেন।

হাবিবুর রহমানের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাজিউড়া গ্রামে। ১৯৯৬ সালে এসএসসি ও ১৯৯৮ সালে নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। মদনপুর শাহ সুলতান কলেজ থেকে ডিগ্রিও সম্পন্ন করেন। তিনি যখন পাঠ নিতে যেতেন তখন খুব কষ্ট হতো। প্রায়ই ১৫-১৬ কিলোমিটার হাঁটতে হতো তাঁকে। সে কারণে গ্রামের প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৫ সালে পাঠশালা খোলেন। ২০ শতক জমিতে স্থাপিত বিদ্যালয়টি গ্রামের মানুষের সহায়তায় ১৯৯৭ সালে পূর্ণ রূপ পায়। পল্লী দৃষ্টিহীন উন্নয়ন সংস্থার সাজিউড়া অটিজম ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনও পেয়েছে। হাবিবের শিক্ষার আলো ছড়ানোর আগ্রহ দেখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার।

আইইসিডব্লিউডি প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ১৪ জন দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ এবং প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা হাবিবকে সম্মানী দেয় সংস্থাটি। বর্তমানে বিদ্যালয় ১৬৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের কেউ দৃষ্টিহীন, কেউ শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী। প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। ১০ শিক্ষার্থী আবাসিক হিসেবে আছে। হাবিব ছাড়াও ১৩ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে স্কুলটি চালিয়ে নিলেও প্রতিনিয়ত নানা সমস্যায় পড়তে হয় হাবিবকে। স্বেচ্ছায় শ্রম দেওয়া শিক্ষকরা অনিশ্চিত জীবনের পথে হাঁটছেন। এ সমস্যা কেবল তাঁর বিদ্যালয়ে নয়, দেশে প্রতিবন্ধীদের অন্য অনেক বিদ্যালয়েও অভিন্ন চিত্র। বিদ্যালয় এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ছোটাছুটি করেছেন হাবিব। অনেকবার আবেদন ও তদন্ত হলেও তাঁর বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হয়নি। এ অবস্থায় ২০২০ সালে অনলাইনে আবেদন করা সব প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি ও এমপিওর দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান তিনি। সে জন্য গত রোববার দুপুরে নেত্রকোনা পৌরসভার আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন। নিজের দাবির কথা লেখা পোস্টার বুকে নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। প্রতিদিন ২৫-৩০ কিলোমিটার হাঁটার লক্ষ্য তাঁর। নেত্রকোনা থেকে রোববার রাতে তারাকান্দার কাশিগঞ্জে পৌঁছেন। সেখানে রাত কাটিয়ে সোমবার সকাল ৯টার দিকে পৌঁছান ময়মনসিংহ শহরে। নগরীর টাউন হল এলাকায় প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টারে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কাজ সেরে ছোটেন ঢাকার পথে।

প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টারে এবং ময়মনসিংহ-ঢাকা সড়কে কথা হয় হাবিবের সঙ্গে। সড়কের মাসকান্দা এলাকায় কয়েকটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পদযাত্রায় সংহতি জানান। তারা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান হাবিবকে। তপ্ত রোদে পিচঢালা পথে হাবিবুর রহমান হাঁটতে থাকেন। কিছুদূর এগিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মোছেন কপালের ঘাম। সমকালকে তিনি জানান, তাঁর বিদ্যালয়ের ১৫ বছর পর প্রতিষ্ঠা হয়েও এমন একটি বিদ্যালয় সরকারি সুবিধার আওতায় এসেছে। কিন্তু তাঁর বিদ্যালয়টি এখনও ধুঁকছে। বিদ্যালয়টির জন্য মন্ত্রীদের কাছে বহুবার গেছেন, অনেক আবেদন করেছেন, অনেক তদন্ত হয়েছে কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। দুই মাস আগে জানতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ বিষয়ে কেউ সমাধান দিতে পারবেন না। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থার কথা তুলে ধরতে হাঁটছেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বীকৃতি চান।

বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নেত্রকোনা জেলা শাখার আহ্বায়ক আবদুর রব খান ঠাকুর বলেন, জেলায় প্রতিবন্ধীদের মোট ২৬টি বিদ্যালয়ের মধ্যে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরুর স্ত্রী কামরুন্নেছা আশরাফের গড়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি একমাত্র এমপিওভুক্ত হয়েছে। ত‎াঁরা চান অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এমপিওভুক্ত করা হোক। হাবিবুর রহমান অনেক কষ্ট করে বিদ্যালয়টি চালাচ্ছেন। সরকারি নীতিমালার সবকিছুই এই বিদ্যালয়ের রয়েছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২৬ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, আত্মকর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে প্রতিবন্ধী কমিউনিটি সেন্টার। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালিক গ্রেনার মারাক বলেন, হাবিবের পদযাত্রায় তাঁরা সংহতি জানিয়েছেন। এর মধ্যেমে সরকার শিক্ষালয়গুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে আশা করি।

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, পদযাত্রার ব্যাপারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষক হাবিবুর রহমান তাঁকে ও স্কুলের সভাপতি সদর উপজেলার ইউএনওকে কিছু জানাননি। তাই সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না তিনি।