যে কোনো একটি ছুটির দিনে চলে যেতে পারেন কুলাউরা। পাহাড় ভ্রমণে গেলে মিলবে চোখ ও মনের প্রশান্তি। লংলা পাহাড়, ঝিরিসহ প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

ছুটলাম কুলাউড়া। সঙ্গী দেশের ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণ সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মাইক্রোবাস চলছে মধ্যমগতিতে। যেতে যেতে শ্রীমঙ্গল পেরিয়ে গ্রান্ড সুলতানের পাশ কেটে নয়নাভিরাম চা বাগানের মাঝ দিয়ে শমশেরনগর হয়ে কুলাউড়ার আজগরাবাদ গেলাম। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষমাণ ছিলেন আমাদের গাইড দিলু মিয়া। ভোর তখন সাড়ে ৫টা। দিলুর বসতঘরে ঘণ্টা দুই বিশ্রাম নিয়ে কালাপাহাড়ের [লংলা] চূড়ায় আরোহণের জন্য ছুটলাম।

সবজিক্ষেত, চা বাগান, ছোটবড় ঝিরি পেরিয়ে কালাপাহাড়ের দিকে ছুটছি। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন দেহমন পুলকিত হতে থাকে। যেতে যেতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কালাপাহাড়ের বেল্টে ট্র্র্যাক শুরু করলাম। দিগন্তছোঁয়া উঁচু উঁচু গাছ, নাম না জানা পাখির কলতান, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে খাসিয়াপাড়া পেরিয়ে চলছে ট্র্যাকিং। মাঝেমধ্যে গাছতলায় জিরিয়ে নিই। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিপাত আমাদের পদযাত্রা যেন থমকে দিতে চায়। কিন্তু দে-ছুটের দামালরা তো আর থামবার পাত্র নন। যতই এগিয়ে যাই ততই পাহাড়ের বুনো পরিবেশের মুগ্ধতা চোখ-মনে ভর করতে থাকে। বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ায়, পা দুটোর জোর একটু বেশিই লেগেছে। তবে শক্তি জুগিয়েছে সঙ্গে থাকা খেঁজুর আর বুনো ফল। গাছ থেকে পাড়া বিঁচি কলাগুলোর ছিল সেই স্বাদ। যেতে যেতে ঘণ্টাতিনেক পর গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়ি। তখন আমরা ছাড়া আর কোনো জনমানবের দেখা নেই। সঙ্গী শুধু চারদিকের আছড়ে পড়া সবুজ লতাপাতা। যেন সবুজের গালিচায় মোড়ানো চারপাশ। কিছু গাছের মগডাল দেখি চোখ দুটি ওপরে তোলে।

চূড়ায় আরোহণের জন্য কালাপাহাড়টা অনেকটা সময় প্রায় একই জায়গা দিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়। উঠতে উঠতে বেলা প্রায় ২টা। হুট করেই ঝোড়ো হাওয়াসহ তুমুল বৃষ্টি। দ্রুত এগিয়ে আশ্রয় নিই নুনছড়া ক্যাম্পে। কর্মরতদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে পাহাড়ের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে বৃষ্টি থামল। কালাপাহাড়ে খাসিয়াদের বসবাস। তাই তাদের আধিপত্যও বেশি। ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের ভিউ চমৎকার। চারদিক সবুজ আর সবুজ। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে দোলে বৃক্ষরাজি। নয়নাভিরাম সব দৃশ্যপট। কিন্তু পাহাড়ের নাম কালা কেন সেটাই মাথায় খেলছিল না। এর রহস্য জানার মতো নির্ভরযোগ্য কারও সাক্ষাৎও পেলাম না। উপস্থিত লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ক্যাম্প থেকে চূড়ায় যেতে লাগবে বড়জোড় ২০ মিনিট। তবে জোঁকের তাণ্ডব পেরোতে হবে।

সঙ্গে থাকা জোঁক প্রতিরোধক তেল মাখিয়ে নব উদ্যমে ছুটলাম। ক্যাম্পের লোকজন হাতির কথাটাও মনে করিয়ে দিল। হ্যাঁ, যে কথা সেই কাজ। হাতির মলের অভাব নেই। তবে তেলের কারণে পাহাড়ের সাইলেন্ট কিলার জোঁক সুবিধা করতে পারছিল না। ঘন বাঁশঝাড় পেরিয়ে চূড়ার দেখা মিলে। বীর দর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এক পাকুর গাছ। উঠতে উঠতে একেবারে কালাপাহাড়ের চূড়ায়। ঝিরঝির বাতাস জানান দেয় তোমরা সফল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কালাপাহাড়ের চূড়ার উচ্চতা ১০৯৮ ফুট। পাহাড়ের অপর প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। বাংলাদেশে এর ৬০ ভাগ ও অবশিষ্ট অংশ ভারতের উত্তর ত্রিপুরায়। আমাদের কালাপাহাড় ভারতে রঘুনন্দন নামে পরিচিত। পুরো সিলেট বিভাগের মধ্যে কালাপাহাড় হলো সবচেয়ে উঁচুতম চূড়ার পাহাড়।

স্থানীয়রা এই পাহাড়কে লংলা নামেও ডাকে। চূড়া থেকে চারপাশের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সরেজমিনে দেখা ছাড়া লিখে বোঝানো দায়। ইচ্ছে থাকতেও হাতি ও জোঁকের যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ অবস্থান করা গেল না। তাই ছুটলাম এবার ভিন্ন পথে। ফেরার পথে দেখে নেব কালাপাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা দীর্ঘতম ঝিরি। এবারের পথটা যেন আরও বেশি রোমাঞ্চকর। কিছুদূর যেতেই দেখি অল্প সময় আগেই রেখে যাওয়া হাতির তাণ্ডব। কচি বাঁশঝাড়গুলো লন্ডভন্ড। গাইড আমাদের থামিয়ে দিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি আঁচ করেন। ১২ বছর বয়স থেকেই কালাপাহাড়ে গাইডের বিচরণ। অপেশাদার হওয়ার দরুন অফিশিয়াল তথ্য তেমন দিতে না পারলেও কালাপাহাড়ে থাকা জন্তু-জানোয়ারের চরিত্র চেনায় বেশ পটু। গাইডের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে এগোতে থাকি। জংলি পথ।

ভুল হলেই সোজা ভিন দেশে। পাহাড়িদেরও মনে হয় এপাশটায় যাতায়াত তেমন নেই। যেতে যেতে ঝিরির দেখা মেলে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ক্লান্তি দূর করি। হাঁটতে হাঁটতে ছোটখাটো একটি ঝরনার দেখা মেলে। পানি খুব বেশি ছিল না। কিন্তু গা ভেজাতে আলস্য করিনি। এরপর টানা প্রায় দুই ঘণ্টা হাইকিং/ট্র্যাক করে ঝিরি ও বুনোপথে আজগরাবাদ পৌঁছি। যাঁরা কালাপাহাড়ে আরও বেশি ট্র্যাক করতে চান তাঁরা আজগরাবাদ হয়ে, পার্শ্ববর্তী উপজেলা জুড়ীর ফুলতলা দিয়ে প্রস্থান করতে পারেন। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একই অঙ্গে বহুরূপের নয়নাভিরাম প্রকৃতির ঝাঁপি, সৌন্দর্যের আধার কালাপাহাড় তার আপন রূপের ডালি মেলে ধরে রেখেছে।

যাবেন কীভাবে :ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া চলাচল করে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রবির বাজার হয়ে আজগরাবাদ অথবা পাশেই বেগুনছড়াপুঞ্জি হয়েও যাওয়া যাবে।

থাকা-খাওয়া :রাতে রওনা হয়ে দিনে দিনে ঘুরে চলে আসা যাবে। রাতে থাকতে চাইলে রবির বাজারে সাধারণ মানের বোর্ডিংয়ে থাকা যাবে। খাবারের জন্য গাইডের হেল্প নিতে পারলে হোমমেড মিলে যেতে পারে। এ ছাড়া আজগরাবাদে তেমন ভালো মানের রেস্টুরেন্ট নেই।