
ফাইল ছবি
ভোটের আগেই মেলাতে হবে সমীকরণ, বাড়াতে হবে জনমত, ঘোচাতে হবে দূরত্ব। এই যোগ-বিয়োগের হিসাবটা মাথায় রেখে সরকারের সঙ্গে সেতু তৈরির চেষ্টা করছে ইসলামভিত্তিক সংগঠনগুলো। সরকারও তাদের ব্যাপারে আগ্রহী। এরই অংশ হিসেবে শর্তসাপেক্ষে সমঝোতা হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে। নানা কারণে আলোচনায় থাকা এই সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা কারাবন্দি দীর্ঘদিন। ভোটের আগে তাঁদের মুক্ত করতে চায় হেফাজতে ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতকে কিছুটা ছাড় দিয়ে 'নাটাই' নিজেদের মুঠোয় রাখতে চাইছে। এজন্য নেতাদের জামিন দেওয়ার আগে নেওয়া হচ্ছে মুচলেকা, দেওয়া হচ্ছে শর্ত।
সরকার বিব্রত হয় এমন কোনো কিছু করা হবে না; রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে না- এমন কিছু শর্ত মানলেই মিলছে জামিন। বিষয়টি নিয়ে এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গেও দেখা করেছেন হেফাজত নেতারা। সেখানেও আলোচনা হয়েছে শর্তযুক্ত মুচলেকা ও জামিন নিয়ে। এর পর গত ১০ মাসে অন্তত অর্ধশত হেফাজত নেতা জামিন পেয়েছেন। তবে হেফাজতের দাবি, এটি পর্যাপ্ত নয়। এখনও তাদের অনেক বড় নেতা কারাবন্দি। ভোটের আগে তাই চাপ আরও বাড়াবে হেফাজত। শিগগির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের নিয়ে তারা বৈঠক করবে। হেফাজতের আমির এখন অসুস্থ। তিনি সুস্থ হওয়ার পরই শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকটি হতে পারে। কারাবন্দি বড় নেতাদের তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করারও চিন্তা রয়েছে তাদের। সমকালকে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন হেফাজতের একাধিক নায়েবে আমির।
এ ব্যাপারে হেফাজতের আমির আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানান আমিরের সহকারী মোহাম্মদ। তবে এর আগে ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসায় বসে হেফাজতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমকালের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন আমির। মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী তখন বলেছিলেন, 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। আটক নেতাকর্মীর জামিনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। কিছু নেতাকর্মীর জামিনও হয়েছে। তবে অনেক বড় নেতা এখনও কারাবন্দি। ভোটের আগেই তাঁদের মুক্ত করার ব্যাপারে আবার কথা বলব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে।' মুচলেকা দিয়ে জামিন পাওয়া প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি তিনি। আল্লামা মুহিবুল্লাহ বলেন, 'সরকার যেভাবে বলছে আমরা সেভাবেই কাজ করছি।'
শর্ত মানতে রাজি হেফাজত: হেফাজতের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন কমিয়ে আনা এবং কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে এরই মধ্যে সচিবালয়ে বৈঠক করেন সংগঠনটির নেতারা। এ সময় হেফাজত নেতাদের মুক্তির বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে বেশকিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। হেফাজত নেতারাও সেগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কারাগারে বন্দি থাকা নেতাকর্মীকে নিজেদের জিম্মায় জামিনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। হেফাজত নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন, নেতাদের মুক্তি দেওয়া হলে তাঁরা কওমি মাদ্রাসায় কোনো রাজনীতিতে জড়াবেন না। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজত নেতাদের জানিয়ে দেন, এ বিষয়ে আমরা আরও আলোচনা করব, যা হবে আদালতের মাধ্যমেই করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা ইয়াহিয়াসহ সংগঠনের ছয় জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন।
মুচলেকার ইঙ্গিত চিঠিতে: নেতাকর্মীরা জামিন পেলে সরকার 'বিব্রত' হয়- এমন কাজে জড়িত না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় হেফাজত। গত জুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা ওই চিঠিতে নেতারা বলেন, 'আমরা কথা দিচ্ছি, জামিন পেয়ে নেতাকর্মীরা এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন না, যাতে রাষ্ট্র ও সরকার বিব্রত হয়।' এরপর হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আবারও বৈঠক করেন। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর হেফাজত নেতারা একের পর এক জামিন পাচ্ছেন। গত ১০ মাসে সারাদেশে এ সংখ্যা হবে অর্ধশত।
জামিন মিলছে মুচলেকায়: মুচলেকা দিয়ে সর্বশেষ জামিন পান মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের সময় ভাঙচুর, মারামারি, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার ২০ মামলার আসামি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর নামে আরও ৮টি হাজিরা পরোয়ানা ছিল। হাটহাজারী থানার সর্বশেষ তিনটি মামলায় জামিন পান তিনি। সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিও। পল্টন ও মতিঝিল থানায় করা ৭ মামলায় জামিন পান তিনি। এর আগে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান হেফাজতের তিন কর্মী। গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় হামলার ঘটনায় করা মামলার আসামিদের মধ্যে চার হেফাজত কর্মী হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। মার্চের ঘটনায় হেফাজতের অন্তত ৩০ শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ জামিন পেয়েছেন। তবে সব মামলায় জামিন না হওয়ায় অনেকের মিলছে না মুক্তি। এমনই একজন মাওলানা আজিজুল হক। তাঁর নামে ২৯ মামলা থাকলেও ২৮টিতেই জামিন পেয়েছেন তিনি। পটিয়ার একটি মামলায় জামিন পেলে মুক্ত হবেন তিনি।
সমঝোতায় থমকে আছে মামলার গতি: গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের বিরুদ্ধে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলায় মোট এজাহারভুক্ত আসামি তিন হাজার ২৭০ জন। তবে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে হেফাজতের সাড়ে পাঁচশ নেতাকর্মীকে। এজাহারের বাইরেও অচেনা ৮৩ হাজারের বেশি আসামি আছে। এর বাইরে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের নাশকতা এবং পরবর্তী সময়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে আরও ৮৩ মামলা আছে। তবে এখন কোনো মামলারই গতি নেই। যেমন- হাটহাজারী থানায় করা ১৩ মামলার কোনোটিরই অভিযোগপত্র হয়নি। সব আছে তদন্ত পর্যায়ে। অথচ ২০১৩ সালের মামলাও আছে এতে। জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, 'আমি নতুন এসেছি। কেন মামলার কাজে অগ্রগতি নেই তা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।'
মন্তব্য করুন