
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আইসোলেশন ওয়ার্ডের বারান্দায় রোগী-সমকাল
কক্ষে শয্যা খালি নেই। মেঝেতেও রোগী। সেখানেও ঠাঁই না পেয়ে বারান্দায় মশারির ভেতরে আছেন ১৯ বছরের সালমান। পাশে মা সাজেদা খাতুন। গত সোমবার ভর্তি হওয়া সালমান আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু আইসোলেশন ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে দেখা মেলে এমন চিত্রের।
ওয়ার্ড থেকে জানানো হলো, এখন হাসপাতালে ৪৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে আজ (বৃহস্পতিবার) ১০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়তে শুরু করায় অন্তত ৮০ জন রোগীকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া যায় সেই প্রস্তুতি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলায় ডেঙ্গু আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে।
এক পাশে নারী ও এক পাশে রয়েছে পুরুষ ওয়ার্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে, ওয়ার্ডে স্থান না হওয়ায় বারান্দায় ছয়জন রোগীকে রাখা হয়েছে। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের আটলা গ্রামের আবুল হাসেমের ছেলে মো. সালমান পেশায় রড মিস্ত্রি। ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় গত দুই বছর ধরে রড মিস্ত্রির কাজ করেন। ঢাকায় টানা চার দিন জ্বর থাকার পর গত শুক্রবার সেখানে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। বাড়িতে ফিরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ভর্তি হন নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে। সেখান থেকে গত সোমবার ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো বলে জানালেন তিনি।
কদিন বাদেই শাহীনুর রহমান শান্তকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে হবে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়নের সালরা গ্রামের আবদুল হালিমের ছেলে শান্ত গত শুক্রবার থেকে জ্বরে আক্রান্ত হন। গত রোববার ডাক্তার দেখানোর পর ডেঙ্গু ধরা পড়ায় মঙ্গলবার ভর্তি হন হাসপাতালে। শান্তর মা শারমীন আক্তার বলেন, বাড়ি ছেড়ে শান্ত কোথাও যায় না। কীভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো বুঝতে পারছি না।' টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার লাহুলা ইউনিয়নের রানিয়াত গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে সোহেল মিয়া (২৬) ঢাকায় আনারস বিক্রি করেন। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৪ অক্টোবর ডাক্তার দেখানোর পর ধরা পড়ে ডেঙ্গু। তিনি বুধবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বৃহস্পতিবার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর ছিল সোহেলের। সোহেল মিয়া বলেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন তাঁর শরীরে রক্ত দিতে হবে। তাই এলাকায় লোকজনের কাছে রক্তের জন্য খবর পাঠিয়েছেন।' নেত্রকোনা পৌরসভার মইনপুর এলাকার শাকিল আহমেদ ২৩ অক্টোবর ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, চিকিৎসা ভালো দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। মুক্তাগাছা পৌর এলাকার বাসিন্দা শরীফা আক্তার ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ২২ অক্টোবর থেকে অসুস্থ বোধ করলেও পরদিন ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আগের চেয়ে ভালো আছেন বলে জানান শরীফা।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪০১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৩৪ জন, নারী ৬০ জন এবং সাত শিশু ছিল। তবে চলতি মাসেই গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৬৯ জন। গত বুধবার ৬৪ রোগী ভর্তি থাকলেও গতকাল সকাল পর্যন্ত কিছু রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত রোগী ছিল ৩৯ জন। তবে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আরও নতুন অন্তত ১০ রোগী ভর্তি হন।
হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ফোকাল পারসন ডা. কায়সার হাসান খান বলেন, অক্টোবর মাসে ছিল সবচেয়ে বেশি রোগী। শীতের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে রোগী কমতে শুরু করবে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে মশারি টানানোর কারণে জায়গা একটু বেশি লাগায় বারান্দায়ও রোগী রাখতে হচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটের ডাক্তারদের সমন্বয় করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. জাকিউল ইসলাম বলেন, চলতি মাসেই সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছেন। রোগীর চাপ সামলাতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আক্রান্তদের অধিকাংশ ঢাকা থেকে আসা।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতন হওয়ার আহ্বান: ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হচ্ছে। ১৪০টি হট স্পটকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড। পাশাপাশি এডিস মশা শনাক্তে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযানও। এ ছাড়া কোনো নির্মাণাধীন ভবন বা কোনো প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে। গত তিন মাসে লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতার জন্য নগরীতে রোড শোর মাধ্যমে সচেতনতামূলক গান প্রচার, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, স্থানীয় চ্যানেলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রহণ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, ঘরের আঙিনায় বা অন্য যে কোনো স্থানে তিন দিনের বেশি জমে থাকা পরিস্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। এসব স্থানে নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি নিজ উদ্যোগে সরিয়ে ফেলতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতার মাধ্যমেই ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতা অর্জন সম্ভব।
মন্তব্য করুন