দীর্ঘদিন ধরে মাতামুহুরী নদীতে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ অব্যাহত থাকায় এক সময়ের মৎস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত মাতামুহুরী নদী এখন মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে। ফল এ নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা ৫ শতাধিক পরিবার বেকার হয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

মিয়ানমার সীমান্ত থেকে উৎপত্তি হওয়া ২৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মাতামুহুরী নদীতে একসময় হরেক প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে একশ্রেণির লোভী মৎস্য শিকারি আলীকদম, লামা ও চকরিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টে বিষ প্রয়োগ করে মাছ আহরণ অব্যাহত রেখেছে। ওইসব দুর্বৃত্ত নদীতে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বিষ প্রয়োগ শুরু করে। বিষাক্ত পানি পান করে বেশিরভাগ মাছ আধমরা অবস্থায় নিচের দিকে ভেসে উঠলে মৎস্য শিকারিরা নেট জাল দিয়ে এসব মাছ আহরণ করে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে। এভাবে বিষ প্রয়োগ করে মৎস্য আহরণ অব্যাহত থাকায় মাতামুহুরী নদীতে মৎস্যভান্ডার তছনছ হয়ে গেছে।

চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের মাঝেরফাঁড়ি এলাকার মৎস্য শিকারি কফিল উদ্দিন বলেন, একসময় নদীতে বড়শি ও জাল দিয়ে কয়েক কেজি মাছ পাওয়া যেত। এখন আর সেই সুদিন নেই। সারাদিন বড়শি অথবা জাল দিয়ে ২৫০ গ্রাম মাছ পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অসংখ্য মৎস্য শিকারি এখন মাছ শিকার বাদ দিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন।

ফাঁসিয়াখালীর ঘুনিয়া এলাকার শশীজল দাশও বলেছেন একই কথা। তাঁদের গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার মাতামুহুরী নদীর মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন আর কেউ মাছ শিকারে নিয়োজিত নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। তার মতে, বেশ কয় বছর ধরে মাতামুহুরী নদীতে বিষ প্রয়োগ অব্যাহত থাকায় মাছের প্রজনন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

প্রবীণ একজন মৎস্য শিকারি আবদুল করিম বলেন, ভাদ্র মাসে মাতামুহুরী নদীতে গলদা চিংড়ির পর্যাপ্ত পোনা পাওয়া যেত। এখন তেমন পোনা আহরণ করা যায় না। তার মতে, মাতামুহুরী নদীতে বিগত ১০ বছর ধরে বিষ প্রয়োগ অব্যাহত থাকায় বোয়াল, রুই, কাঁকড়া, বেলে, ঘাউরা ও গলদা চিংড়ি আর পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে বাবু নামে একজন জেলে দাবি করেছেন, এ নদীতে তিনি উপজেলায় শতাধিক গভীর পানির কুম (গভীর স্থান) ছিল। বর্তমানে সেসব কুম ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের অভয়াশ্রম ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে মৎস্য প্রজনন আর হচ্ছে না। এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা ফরহান তাজিম বলেন, '৩টি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত এ মাতামুহুরী নদী অরক্ষিত। রাতের আঁধারে কোথায় কে বিষ প্রয়োগ করছে তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।' তিনি আরও বলেন, 'মিঠাপানির মৎস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত মাতামুহুরী নদীতে আগের মতো মাছ মিলছে না।' আলীকদম উপজেলার একজন সংবাদকর্মী মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, 'মাতামুহুরী নদীতে বিষ প্রয়োগ ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের বংশবিস্তার হচ্ছে না। এমনকি মাতামুহুরী নদীর শাখা তৈন খালের মাছ কুমেও মাছের দেখা মিলছে না।'

চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, 'বিষ প্রয়োগ, তামাক ও সবজির বিষের বর্জ্য নদীতে পড়ায় দিন দিন মৎস্যভান্ডার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিষ প্রয়োগ বন্ধ করা গেলে মাছের বংশবিস্তার বাড়তে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'পাহাড়ের গাছ নিধন, পাথর উত্তোলনজনিত কারণে প্রতি বছর বর্ষায় পাহাড় ভেঙে ভেসে আসা পলি মাটিতে মাতামুহুরী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে মৎস্যভান্ডার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিকল্পিতভাবে এ নদী ড্রেজিং না করলে একসময় মাতামুহুরী নদী মরা নদীতে পরিণত হবে। মাছের অস্তিত্বই থাকবে না নদীতে।'