কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ঘেঁষে দেবিদ্বার নিউমার্কেট চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। তার পাদদেশে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ৭টা-৮টা পর্যন্ত বসে 'শ্রমজীবীর হাট'। জীবিকার তাগিদে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন শতাধিক শ্রমজীবী মানুষ সেখানে জড়ো হয়। বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন কায়িক শ্রম। এই শ্রম বিক্রির টাকায় চলে তাঁদের সংসার। মেটে স্ত্রী-সন্তানের আবদার, মা-বাবার চিকিৎসা। যেদিন কাজ জোটে না, সেদিন শূন্য হাতে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরেন কেউ কেউ। সপ্তাহে এক-দু'দিন কাজ পেলে তাঁদের জোটে ভাত, না পেলে অর্ধাহার-অনাহারে কাটে রাত।

কাজ নেই তাই ঘরে ভাত নেই। টাকার অভাবে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা নেই। সন্তানের আবদার পূরণে ব্যর্থতার গ্লানি বাবার। স্ত্রী শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছেন। সম্প্রতি এমন শত দুঃখ-কষ্টের কথা উঠে এসেছে দেবিদ্বার উপজেলার 'শ্রমজীবীর হাটে' আসা শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপে।

কথা হয় দেবিদ্বার উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে, স্ত্রী, বাবা-মা'সহ সাতজনের সংসার। ছোট ছেলেটা কয়েক দিন ধরে মাছ দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে। প্রতি দিনই বলেন 'বাবা আজ মাছ নিয়ে আসব'। গত দুই দিন কোনো কাজ পাননি। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ২০০ টাকা ধার করেছেন। ভেবেছিলেন কাজ পেলে দিয়ে দেবেন, কিন্তু কাজ মিলছে না।

মুগসাইর গ্রামের আল আমিন জানান, একজন গৃহস্থ কাজের লোক নিতে এলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন, কে কাজটা বাগিয়ে নেবেন। মাটি কাটার মজুরি ৪০০ টাকা চাইলে মালিক ৩০০ টাকার বেশি দিতে চান না। দর কষাকষি করে পরে ৩০০ টাকায় রাজি হয়ে যান অনেকে। তবে বয়স্কদের কেউ কাজে নিতে চান না। গত মাসে প্রায় প্রতিদিনই 'শ্রমজীবীর হাটে' গিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে মাত্র ৭-৮ দিন কাজ পেয়েছেন। দৈনিক মজুরি পেয়েছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। ঘরে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত বাবা, মা' শ্বাসকষ্টের রোগী, তারপর রয়েছে স্ত্রী-সন্তান। তাঁদের ওষুধ-পথ্য দূরের কথা দু'মুঠো ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন।

মাশিকাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আলতব আলী বলেন, আমাদের জীবন অর্ধাহার-অনাহারে কাটছে। তার ওপর কাজ পাননি। বিবাহবিচ্ছেদের শিকার মেয়ে ঘরে, তার পরনের কাপড় কিনে দিতে পারছেন না। তিনিও অসুস্থ। চিকিৎসক বলেছেন- পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। এমনিতে কাজ নেই, ঘরেও ভাত নেই আবার চিকিৎসা করাবেন কী দিয়ে।

ধামতী গ্রামের আলী আজ্জম বলেন, 'ভাগ্যক্রমে কাজ পেলেও ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা মজুরি পাই। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার মালিক বহন করেন। যাতায়াত খরচ ৬০-৭০ টাকা, চা-বিড়ি ৩০ টাকা। বাকি থাকে ২০০-২৫০ টাকা। এক কেজি চাল, এক কেজি আটা, এক কেজি আলু কেনার পর তেল, লবণ, ওষুধ, বাচ্চাদের আবদার, কাপড়, কিস্তির টাকার হিসাব মেলাতে পারছেন না। অর্ধাহার-অনাহারে চলছে জীবন। গরিবের কষ্টের জীবন নিয়ে কেউ ভাবেন না।

কথা হয় শ্রমিক নিতে আসা দুই গৃহস্থের সঙ্গে। হাটে আসতেই ৩০-৬০ জন দিনমজুর কাজ পেতে তাঁদের ঘিরে ধরেন। দেবিদ্বার গ্রামের আতিকুর রহমানের জানান, ৪০০ টাকার মজুরির স্থলে ৩০০ টাকায় দুই শ্রমিক নিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, কম মজুরিতে শ্রমিক পেলে বেশি দেব কেন

বাকসার গ্রামের এক গৃহস্থ আসেন দুই শ্রমিক নিতে। বয়স্ক হওয়ায় তাঁর কাছে গিয়েও কাজ পেলেন না দুই দিনমজুর। ৪০০ টাকা করে তিনজন শ্রমিক নিলেন তিনি। মজুরি নিয়ে দর কষাকষি না করে ৪০০ টাকায় রাজি হলেন কেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'পাথর টানার পরিশ্রমের কাজ, তাই দামাদামি করিনি।' একই কারণে বয়স্ক শ্রমিক নিতে চাননি তিনি।