
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। শীর্ষ পদপ্রত্যাশী প্রায় অর্ধশত। তবে নতুন কমিটিতে পদ পেতে কোটি টাকা লেনদেনের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কয়েক লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, কুবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীরা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। নতুন কমিটিতে তাঁদের আসার সুযোগ না থাকায় নিজেদের অনুসারীদের আনতে মরিয়া তাঁরা। ছাত্রলীগের আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২০১৫ সালে গঠিত কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী ও বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্বজন বরণ বিশ্বাস। ২০১৭ সালে ওই কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর রেজা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সহসম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা দু'জনই নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে চাচ্ছেন। এ দু'জনের গুটি কয়েক অনুসারী রয়েছেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই অছাত্র বলে দাবি বিরোধীদের। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ২৭ বছরের বেশি বয়সী কেউ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা বা কর্মী হতে পারবেন না। তবে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে বয়সসীমা ২৯ নির্ধারিত হয়। সে অনুযায়ী, রেজা নিজেই বয়সোত্তীর্ণ। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স ৩১। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হওয়া রেজা-ই-এলাহী ২০১৬ সালেই স্নাতক পাস করে বের হয়ে যান। তবে নতুন কমিটিতে পদ পাওয়ার আশায় সম্প্রতি ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের স্নাতকোত্তর সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।
সভাপতি ইলিয়াস হোসেনের অভিযোগ, কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহসম্পাদকের মতো শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে এসে টাকার বিনিময়ে এখন সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন রেজা। এরই মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এক নেতার শ্যালিকাকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক এক নেতার মাধ্যমে টাকাগুলো দেওয়া হয়েছে।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, 'রেজা-ই-এলাহী শীর্ষ নেতাদের এরই মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাঁর গ্রুপ থেকে দেওয়া হলে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে রাজি আছেন তিনি।' এসব টাকা কার মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছে, তাঁদের নাম-পরিচয় বলতে রাজি হননি ইলিয়াস। তবে কুবি শাখার জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, আল-নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ এক সহসভাপতির মাধ্যমেই এ লেনদেন হয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে রেজা-ই-এলাহী বলেন, 'কোথাও একটি পয়সাও আমার দিতে হয়নি। এগুলো মিথ্যা।'
আরেক পক্ষের অভিযোগ, শাখা ছাত্রলীগের কমিটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে ইলিয়াসের কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের চুক্তি রয়েছে। তাঁদের দাবি, যুবলীগের এক সদস্যের মাধ্যমে এ লেনদেনের চুক্তি হয়েছে। কুবির অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদনকারীর বিপরীতে ইলিয়াস ও যুবলীগের ওই সদস্যের নাম রয়েছে। যদিও তাঁদের কেউ ওই জমির মালিক নন। যুবলীগ নেতার বাড়িও ওই এলাকায় নয়। এই জমির বিপরীতে ৬ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার ১০৬ টাকা ধার্য করা হয়েছে।
তবে লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করেছেন ইলিয়াস হোসেন। তাঁর ভাষ্য, যুবলীগের ওই সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় কাগজে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে। এখানে মোট ২১ জন রয়েছেন। তাঁর মধ্যে রেজা-ই-এলাহী একজন। তাঁদের শুধু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জমির মালিক নন তাঁরা।
পদ-বাণিজ্যের একই অভিযোগ রয়েছে বিগত কমিটির অনেক নেতার বিরুদ্ধেও। ২০১৫ সালে কুবি শাখার কমিটি আনতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন বর্তমান সভাপতি ইলিয়াস হোসেন। সে সময় কমিটিতে তাঁকে না এনে অন্যদের আনতে ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল বলে দাবি তাঁর। গত ৩১ অক্টোবর জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের জন্য আসা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সামনেই এ অভিযোগ তোলেন তিনি।
এ ছাড়া রেজা ও তাঁর অনুসারীরা নতুন কমিটিতে কোটি টাকা খরচ করে পদ আনতে চাচ্ছেন বলে ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে অভিযোগ তুলেছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাঁদের একজন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের সভাপতি রাফিউল আলম দীপ্ত। গত ১ নভেম্বর তাঁর ফেসবুক ওয়ালে দাবি করা হয়, নতুন কমিটিতে সভাপতি প্রার্থী রেজা-ই-এলাহী ঠিকাদারি, জমি বেচাকেনা, ইজারাসহ বিভিন্ন ব্যবসা করে অঢেল অর্থ কামিয়েছেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অর্থের জোরে নতুন কমিটিতে সভাপতি পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে সমকাল প্রতিনিধির। তাঁরা বলছেন, টাকার মাধ্যমে কমিটি এনে পদ-বাণিজ্য হলে ছাত্রলীগ ত্যাগী ও আদর্শিক কর্মীদের হারাবে।
কমিটিতে সভাপতি পদপ্রার্থী কাজী নজরুল ইসলাম হলের সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশ বলেন, অনেকেই রাজপথে রাজনীতি না করে টাকা দিয়ে কমিটি আনতে চান। রাজপথে রাজনীতি করা লোকদের এত টাকা এবং লবিং থাকে না। রাজপথের কর্মীদের যদি কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ মূল্যায়ন না করে, তাহলে মূল্যায়ন করার মতো আর কেউ নেই।
এসব বিষয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ ও নির্বাহী সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জাব্বার রাজ বিষয়গুলো অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিকে কেন্দ্র করে প্রথম থেকেই গুঞ্জন চলছে। বিষয়গুলো ভিত্তিহীন।
একই কথা বলেছেন আল-নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম রিয়াদ হাসান। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ আসে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়াদ হাসান বলেন, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবস্থা নেবেন।
কথা হয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নিতে আসা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে। তাঁর দাবি, ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ-বাণিজ্যের সুযোগ নেই। যোগ্য ও যাঁদের ছাত্রত্ব আছে, কেবল তাঁরাই কমিটিতে আসবেন।
মন্তব্য করুন