
সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ঘটনায় করা মামলার কোনো কূল-কিনারা হয়নি গত ১০ বছরেও। সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য করা ৪৬ তারিখের মধ্যে মাত্র ৯ দিন সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ১০৪ জনের মধ্যে ৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রতাকে ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিকদের পক্ষে রাষ্ট্রের দায়সারা মনোভাবকে দায়ী মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। শাস্তির বদলে তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন মৎসজীবী লীগের নেতা বানিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ শ্রমিক পুড়ে মারা যান। আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে আহত হন অন্তত ৫৫০ জন। এদের মধ্যে পরে আরও চার জন্য শারীরিক অসুস্থতায় মারা যান। সরকার ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ওই দুর্ঘটনার পরের বছর ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৭৫ শ্রমিক নিহত হন। পরপর বড় দুটি দুর্ঘটনার কারণে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়ে পোশাক খাত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা জিএসপি স্থগিত করা হয়। বিদেশি ব্র্যান্ড ক্রেতা এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও চাপ আসে। আইনের আওতায় দায়ীদের বিচারের দাবি তোলে বিভিন্ন শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠন।
তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে দুর্ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রতিটি অনুসন্ধানেই মালিক-কর্তৃপক্ষের শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে সার্বিক অবহেলাকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মালিকসহ সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। একটি মামলা করেন এক নিখোঁজ শ্রমিকের ভাই। অপর মামলাটি করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। মামলার পর সিএমএম কোর্টে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাক্ষী করা হয় ১০৪ জনকে। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ওই বছরের ১ অক্টোবর। গত সাত বছরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য সর্বমোট ৪৬টি তারিখ ধার্য হয়। এর মধ্যে মাত্র ৯ দিন রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে। অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ১০৪ জনের মধ্যে মাত্র ৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর ছিল সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ। এ দিনও রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। আগামী ১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে।
'তাজরীনের জন্য ন্যায়বিচার' নামে কয়েকজন গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, আলোকচিত্রীদের একটি সংগঠন গত এক দশক শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাজরীন কারখানায় শ্রমিক হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার। জানতে চাইলে এ সংগঠনের সদস্য সায়দিয়া গুলরুখ সমকালকে বলেন, এক দশকেও এত শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তি না হওয়ায় তাঁরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। এ দেশে কর্মক্ষেত্রে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচার এ পর্যন্ত হয়নি। দায়ী মালিকদের আইনের মুখোমুখি করা হয়নি। বরং তাজরীন কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা বানানো হয়েছে।
গত ১১ মে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সম্মেলনে তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ২০১৮ সালে এ সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন তিনি।
প্রয়োজনে সহায়তা দেবে বিজিএমইএ
তাজরীন দুর্ঘটনার ১০ বছরে বিজিএমইএর কর্মসূচি কী- জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এখন আলাদা করে কোনো কর্মসূচি পালন করছেন না তাঁরা। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এর পরও এ নিয়ে যদি কারও কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে বিজিএমইএর সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, তাজরীন ফ্যাশনস কারখানার মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর পোশাক খাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ কার্যক্রম আরও বেগবান হয়েছে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পোশাক খাতের এখন নিরাপদ কর্মপরিবেশ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে প্রতারণা
জাতীয় গার্মেন্টস কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি জানান, তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধসে নিহতদের নিয়ে একটা চক্র প্রতারণা করছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যা কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, তা নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। দুর্ঘটনাস্থল সাভারের নিশ্চিন্তপুরে এখনও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে দাবি তুলছে, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত নয়। নিহত শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে তারা প্রকৃত শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
আহতরা পাচ্ছেন আজীবন চিকিৎসা :দুর্ঘটনার পর তাজরীন ইনজুর্ড ওয়ার্কার্স মেডিকেল কেয়ার ট্রাস্টের (টিআইডব্লিউএমসি) মাধ্যমে আহতদের আজীবন সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও এবং অন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় এ ট্রাস্ট পরিচালিত হচ্ছে। রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড এবং তাজরীন ট্রাস্ট ফান্ডকে একীভূত করে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে এ ট্রাস্ট গঠিত হয়।
ট্রাস্ট্রের সমন্বয়ক শাহরিয়ার রনি জানান, তাজরীনের আহত ১৭২ জন নিবন্ধিত শ্রমিক বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে গতকাল রোববার পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৪১৮ বার বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা নিয়েছেন। ট্রাস্ট থেকে এসব চিকিৎসা ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে। রানা প্লাজায় আহতদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এ ট্রাস্ট থেকে। ট্রাস্টের তহবিলে ৩ কোটি টাকা একটি ব্যাংকে এফডিআর করা আছে। এখানকার মুনাফা থেকেই ব্যয়ের জোগান দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য করুন