- সারাদেশ
- বিস্ম্ফোরক উদ্ধার ও মামলা নিয়ে নানা প্রশ্ন
বিস্ম্ফোরক উদ্ধার ও মামলা নিয়ে নানা প্রশ্ন

পাবনার চাটমোহরে ককটেল বিস্ম্ফোরণ ও অবিস্ম্ফোরিত ককটেল উদ্ধারের ঘটনায় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে বিস্ম্ফোরক আইনে এ মামলা করে। চাটমোহর থানার ওসি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন জানান, আফ্রাতপাড়া মহল্লায় চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ফুড অ্যান্ড বেভারেজের মালিক হাসাদুল ইসলাম হীরার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে দলটির নেতাকর্মীরা নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠক করছিলেন। অভিযানে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে দুটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা হাসাদুল ইসলাম হীরা বলেন, 'মঙ্গলবার আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিএনপির কোনো বৈঠক ছিল না। দোকান তালা দেওয়া ছিল। আমরা সোমবার দিনের আলোয় বৈঠক করেছি। সেখানে ককটেল বিস্ম্ফোরণের কিছু ঘটেনি। এখন মামলায় দেখছি অনেক কিছু ঘটেছে।' তিনি বলেন, 'দোকানের আশপাশের মানুষও ককটেল বিস্ম্ফোরণের বিষয়ে বলতে পারবে না। অথচ পুলিশ সেখান থেকে ককটেল উদ্ধারও করেছে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ এ নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ৩ ডিসেম্বর বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ বানচালেই নতুন এই কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা।'
চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, 'স্থানীয় এমপির সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে বসেই আমরা বিএনপি অফিসের সামনে ককটেল বিস্ম্ফোরণের তথ্য পাই। বিএনপির চরিত্রই তো এমন। এটি বিশ্বাস না করার কিছু নেই।'
একই জেলার সাঁথিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় মঙ্গলবার রাতে ককটেল হামলার অভিযোগ এনে বিএনপির অন্তত ৬০-৭০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আলম। এজাহারের বরাত দিয়ে ওসি (তদন্ত) কমল কুমার দেবনাথ জানান, মঙ্গলবার রাতে ধোপাদহ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান বাবুল। এ সময় বিএনপির কর্মীরা তিনটি ককটেল বিস্ম্ফোরণ ও চেয়ার ভাঙচুর করে পালিয়ে যায়।
তবে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কেএম মাহবুব মোর্শেদ জ্যোতি বলেন, 'দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে রাতে কর্মসূচি দিচ্ছে। আর আমরা তাতে সমানে ককটেল হামলা করছি- এই বর্ণনা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনিতেই আমরা বিপদে আছি। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বার্থেই আমাদের কর্মীরা এখন এসব করবে না। সমাবেশ বানচালে তাদের এবারের কৌশল দেখে সত্যিই বিস্মিত।'
পাবনার অন্য পাঁচটি উপজেলা ও থানার বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্টেম্ফারণের ঘটনায় বিএনপি, এর অঙ্গ সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাতে ভাঙ্গুড়া থানায় বিএনপি ৯ জনের নাম উল্লেখসহ ৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল জব্বার। ঈশ্বরদী থানায় বিএনপির ৯ জনের নাম উল্লেখসহ ১৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এসআই শীতল কুমার। আটঘরিয়া থানায় ১০ নেতার নাম উল্লেখসহ ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম মুকুল। সুজানগরে তিনটি ককটেল বিস্ম্ফোরণ ও আতাইকুলা থানায় অবিস্টেম্ফারিত ককটেল জব্দের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। গত ২১ নভেম্বর পাবনা শহরের খেয়াঘাট সড়ক এলাকায় ককটেল বিস্টেম্ফারণের ঘটনায় সাতজনের নাম উল্লেখসহ ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সদর থানা পুলিশ।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগে বিভাগীয় সমাবেশ বানচালে ক্ষমতাসীনরা পরিবহন ধর্মঘট, লঞ্চ ও ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। এখন বিস্ম্ফোরক উদ্ধার করে মামলা দেওয়ার কৌশল নিয়েছে। সবখানে হামলা রাতে হচ্ছে, পরে বিস্ম্ফোরক আইনে মামলা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব মামলার সাক্ষীরাও কিছুই জানেন না।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জানান, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশ। এ সমাবেশে লোকসমাগম ঠেকাতে বিভাগের আট জেলা থেকে গত তিন দিনে ৭৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে ৩৭টি মামলায় অন্তত ১০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
তিনি জানান, বগুড়ায় ছয় মামলায় ১৯, জয়পুরহাটে দুই মামলায় ১২, নওগাঁয় ছয় মামলায় ১৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচ মামলায় ২২, রাজশাহীতে চার মামলায় দু'জন, নাটোরে পাঁচ মামলায় তিনজন ও সিরাজগঞ্জে তিন মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দুলু বলেন, 'আগের সমাবেশগুলোতে ধর্মঘট, গাড়িঘোড়া, লঞ্চ চলাচল বন্ধ করেছিল। কিন্তু কোনোভাবেই লোকসমাগম ঠেকাতে পারেনি। এবার রাজশাহীর গণসমাবেশ ঘিরে সরকার নতুন আইটেমে মামলা ও গ্রেপ্তার হাজির করেছে। গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর পরও গণসমাবেশ সফল হবে।'
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, 'যেখানে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্ধার করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে মামলায় আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অরাজকতার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
বিস্ম্ফোরক আইনে মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক বিল্লাল হোসেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার ১০ জনের দু'দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
ঘাটাইল থানার ওসি আজহারুল ইসলাম সরকার জানান, বিএনপি নেতাকর্মীরা সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে নাশকতার উদ্দেশ্যে মঙ্গলবার জমায়েত হয়েছিল। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় ১০ নেতাকর্মীকে আটক ও সাতটি ককটেল জব্দ করা হয়। রিমান্ডে আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।
তবে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা লুৎফর রহমান খান আজাদ সমকালকে বলেন, '১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ সফল করতে উপজেলার দিগড় ইউনিয়নের কাশতলা ভিটিপাড়া এলাকায় ইউনিয়ন বিএনপি কর্মী সমাবেশ করে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ গুলি ছুড়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে নিজেরা ককটেল বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে নাটক সাজায় এবং নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে।'
একই জেলার মির্জাপুরে বিএনপি ও যুবদলের ছয় নেতাকে মঙ্গলবার রাতে আটক করে পুলিশ। মির্জাপুর থানায় নিয়মিত মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয় বলে জানান থানার ওসি শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিম।
রাজশাহীর সমাবেশ ঘিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত তিন দিনে দেশি অস্ত্রসহ ২০টি ককটেল জব্দের দাবি করেছে পুলিশ। এ সময়ে পাঁচ থানায় চার শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তবে বিএনপির দাবি, এসব মামলা সরকারের সাজানো নাটক। নেতাকর্মীদের বাড়িছাড়া করতেই মামলা দেওয়া হয়েছে।
জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাসান ইমতিয়াজ বলেন, 'নাচোলে আমি অবস্থান করছি না অনেক দিন। এর পরও রাজনৈতিক হয়রানি করতে আমার নামে পুলিশ মামলা দিয়েছে।' জেলা বিএনপি আহ্বায়ক গোলাম জাকারিয়া বলেন, 'সরকারের ইন্ধনে পুলিশ রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ বানচালে নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা দিচ্ছে।'
তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার এএইচএম আব্দুর রাকিব জানান, রাজনৈতিক হয়রানি নয়, আলামত উদ্ধারের পর তদন্ত করে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
বগুড়ার আদমদীঘিতে যুবলীগের মিছিলে গতকাল বিকেলে ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। এ সময় দুটি ককটেল বিস্ম্ফোরণ হয়। পরে পুলিশ দুটি অবিস্ম্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করে। আদমদীঘির পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনের এ হামলায় ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান পলাশ, মৃদুল, রিফাত, বাপ্পি ও রাসেল আহত হন। পরে বিক্ষুব্ধরা বিএনপি কার্যালয়ে ভাঙচুর করে।
আদমদীঘি থানার ওসি রেজাউল করিম জানান, এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন।
রংপুর জেলা বিএনপির নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার এসআই রফিকুল ইসলাম এ মামলা করেন।
এদিকে আগামী ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় হামলা, ভাঙচুর ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বিএনপির ৪৭ নেতাকর্মীসহ শতাধিক অজ্ঞাতকে আসামি করে মামলা হয়েছে। গোপীনাথপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ ভূঁইয়া এ মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়, ১৯ নভেম্বর সকালে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন গোপীনাথপুরের বিষ্ণাউড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের সড়কে রিকশা, ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এ সময় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ সমর্থককে মারধর করা হয়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফখর উদ্দিন খান বলেন, 'কুমিল্লার সমাবেশে কসবার লোকজনের যাওয়া ঠেকাতে ক্ষমতাসীনরা হামলা-ভাঙচুরের নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে।' মামলার বাদী মাসুদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী ব্যুরো এবং সংশ্নিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা]
মন্তব্য করুন