মোবাইল ফোনে আগে থেকেই পাখির ডাক ডাউনলোড করে রাখা হয়। সন্ধ্যা নামলে বিল বা জলাশয়ে যখন পাখির দল জড়ো হয়, তখন বড় এলাকাজুড়ে জালের ফাঁদ পাতে শিকারিরা। এর মধ্যে সাউন্ড বক্সে বাজানো হয় ডাউনলোড করা পাখির ডাক। নিজেদের অন্য কোনো সঙ্গীর ডাক ভেবে নিরাপদ স্থান মনে করে ফাঁদের মধ্যে নামতে শুরু করে পাখিরা। এ সুযোগে শিকারিরা জাল টেনে সহজেই ধরে ফেলে পাখিগুলো। ভোর হতেই সেই পাখি পৌঁছে যায় আগে থেকে টাকা দিয়ে চুক্তি করে রাখা ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে।

শীতের শুরুতে সুদূর সাইবেরিয়া ও হিমালয়ের শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও দল বেঁধে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলের কালিয়ার বিভিন্ন বিল ও জলাশয়ে। এ সুযোগে আইনের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় এক শ্রেণির অসৎ পাখি শিকারি এভাবে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলছে পাখি। ধরা পড়ছে দেশি নানা জাতের পাখিও। অথচ পাখি নিধনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলার বড়নাল-ছিলিমপুর বিল, চাঁচুড়ী, ইছামতী, কাঁকড়া, নলামারা, পেড়লী, কুঞ্জপুরের বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, পাহাড়ি হাঁস, কাল দিঘড়ি, মাটি দিঘড়ি, ডুঙ্কর, হাঁস ডিঙ্গিরাজ, খয়রা, কাঁচিচোরা, মদনটাক, শামুকখোলা প্রভৃতি। এসব পাখি বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত বিল ও জলাশয়ে দল বেঁধে অবস্থান নিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই জলাশয় ছেড়ে নির্দিষ্ট আশ্রয়ে চলে যায়। বছরের এই সময়ে এক শ্রেণির শিকারি এসব পাখি শিকারে মেতে ওঠে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, আগে মাছ ও ফড়িং দিয়ে ফাঁদ পেতে এসব পাখি শিকার করা হতো। এরপর কীটপতঙ্গের সঙ্গে কীটনাশকের বিষটোপ দিয়ে, খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে, বড়শি ও কারেন্ট জালের ফাঁদ পেতে ধরা হতো। তবে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পাখি শিকারিদের কৌশলও বদলেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় তারা সহজেই বোকা বানাচ্ছে পাখিদের।

এভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিকার করায় আগে চেয়ে বেশি সংখ্যক পাখি ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। ফলে বিল ও জলাশয় পাখির জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত চলছে নিধনযজ্ঞ। ফলে অতিথি পাখি যে সংখ্যায় আসছে, সে পরিমাণ আর ফিরে যেতে পারছে না। একাধিক সূত্র বলছে, প্রতি রাতে অতিথি পাখিসহ দেশীয় নানা প্রজাতির শত শত পাখি শিকার হচ্ছে। সূর্যের আলো ফোটার আগেই এক শ্রেণির ধনী ক্রেতার কাছে তা পৌঁছে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পাখি শিকারি বলেন, অতিথিসহ সব ধরনের পাখির চাহিদা খুব বেশি। ধরতে পারলে বিক্রিতে সমস্যা নেই। এক শ্রেণির প্রভাবশালী ও ধনী মানুষ অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখেন। ভোরে চাহিদামতো তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। রাস্তাঘাটেও বিক্রি করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা বলেন, তিনি প্রায় প্রতি বছরই অতিথি পাখি শিকারিদের কাছ থেকে কেনেন। পাখির মাংস খেতে মজাদার হওয়ায় রাস্তাঘাটে পেলেই কিনে নেন। চলতি বছরও তিনি একটি দেশি প্রজাতির পাখি কিনেছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্যা ইমদাদুল হক বলেন, পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের পাখি শিকার বন্ধ করা জরুরি। অতিথি পাখির নিরাপত্তায় অসাধু পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে পাখি শিকারিদের ঠেকানো যাচ্ছে না।

কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অতিথি পাখিসহ সব বন্যপ্রাণী দেশের সম্পদ। তাদের রক্ষা করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। খোঁজ নিয়ে এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তথ্য পেলে পাখি শিকারিদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

খুলনা বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা তন্ময় আচার্য বলেন, শীত এলেই পরিযায়ীসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি শিকার করা হয়। এসব অপতৎপরতা বন্ধে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানোসহ টহল জোরদার করা হয়েছে।