পাবনার ঈশ্বরদীতে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ১৩ জন কৃষক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। শুক্রবার পর্যন্ত ১২ কৃষক কারাগারে ছিলেন। এই মামলায় শনিবার রফিক নামে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামে এই ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন অন্তত হাজারখানেক মানুষ। তাদের অধিকাংশই প্রান্তিক কৃষক।

তবে গ্রেপ্তার ১৩ কৃষকের পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় কৃষক নেতারা দাবি, তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ থাকার পরও গভীর রাতে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাদের থানায় নিয়ে যায় এবং কারাগারে পাঠায়। এতে গ্রামে কৃষক ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। রাতে পুলিশের অভিযান দেখে অনেকেই ভয়ে পালিয়েছেন।

ভাড়ইমারি গ্রামে কৃষক কিতাব মণ্ডল সমকালকে বলেন, গ্রামে পুলিশ আসার খবর শুনে অনেকে মনে করেছেন কোনো সন্ত্রাসী ধরতে অভিযানে এসেছে পুলিশ। তবে ভয়ে অনেকে রাতেই বাড়ি ছেড়ে গেছেন। 


এদিকে শুক্রবার পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২ এ ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার কৃষকদের জামিন আবেদন করা হলে আদালত তা নামঞ্জুর করে রোববার শুনানীর দিন ধার্য করেন বলে সমকালকে জানান আদালতের আইনজীবী সহকারী জাফরুল ইসলাম রতন।

ঈশ্বরদীতে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণগ্রহীতা রয়েছেন প্রায় ১ হাজার প্রান্তিক কৃষক। কৃষিকাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তারা। এদের মধ্যে ৪৩৭ জন কৃষকের নাম ঋণখেলাপীর তালিকায় রয়েছে। এদের মধ্যে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১৩ জন কৃষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর থেকে ঋণগ্রস্ত এসব কৃষকরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিনের বেলায় কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে বাড়িতে থাকছেন না।

বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ঈশ্বরদীর নারী কৃষক বেলি বেগম সমকালকে বলেন, গ্রামে গ্রামে যেসব কৃষকরা ৫ হাজার টাকাও ঋণ নিয়েছেন, তারাও আর বাড়িতে থাকছেন না গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে।

এদিকে এ ঘটনা নিয়ে ঈশ্বরদীর সাধারণ কৃষকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন রোববারের মধ্যে গ্রেপ্তার ১৩ কৃষককে জামিনে ছাড়া না হলে দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন তারা। বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ বলেন, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও অনেককে আইনের আওতায় আনা হয় না। অথচ মাত্র ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সে টাকা ফেরত দেওয়ার পরও তাদের জেলে দেওয়া হয়েছে। এটা সাধারণ কৃষকরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

ঈশ্বরদীর নওদাপাড়া গ্রামের কৃষক ও বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সলিমপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ওয়াজেদ আলী বলেন, সারা বছর প্রাকৃতিক নানা কারণে ও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কৃষকরা বারবার পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে এভাবে গ্রেপ্তার করায় কৃষকদের ঘরে ঘরে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত উপজেলার ভাড়ইমারির কৃষক জাহিদুল ইসলাম গাজর জাহিদ বলেন, কৃষিকাজ সচল রাখতে আমাদের মাঝে মধ্যে কৃষি ঋণ নিতে হয়। কিন্তু এই ঋণ নিয়ে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ব্যাংকের নিয়মের মারপ্যাচে ঋণ গ্রহণের পর থেকে ভোগান্তি শুরু হয় কৃষকের। এই ভোগান্তি আর শেষ হয় না।

এদিকে গেপ্তার ভাড়ইমারি গ্রামের সবজি চাষী রজব আলীর ছেলে আল-আমিন বলেন, ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের পাওনা ৩৩ হাজার ৭৭৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ পুলিশ আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।

একইভাবে গ্রেপ্তার কৃষক আতিয়ার রহমানের ছেলে ইকবাল হোসেন সমকালকে বলেন, ব্যাংকের ঋণের ২৩ হাজার টাকা পরিশোধ করার কাগজপত্র দেখানো হলেও পুলিশ আমার বাবাকে গভীর রাতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক, পাবনা শাখার ম্যানেজার জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযাগ করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, আমি নতুন এসেছি। আমার সময়ে কোন মামলা বা কোন ঋণ দেওয়া হয়নি।

সমবায় ব্যাংক, পাবনা শাখার সাবেক ম্যানেজার বর্তমানে নাটোর কর্মরত সৈয়দ মোজাম্মেল মাহমুদ বলেন, ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি বাদী হয়ে কৃষকদের নামে মামলা করেছি। অন্য কেউ হলেও তাকে এটা তাকে করতে হতো। ঋণ আদায় একটা রুটিন ওর্য়াক। এটাকে খারাপ চোখে দেখা ঠিক না।

ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, ২০২১ সালে দায়ের করা মামলায় পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালত থেকে পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মোতাবেক কৃষকদের গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে পাবনা জেল হাজতে পাঠাতে হয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশ আদালতের নির্দেশ পালন করেছে, পুলিশের কিছু করার ছিল না।

পাবনা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী মইনুল ইসলাম মোহন জানান, পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২ এর ম্যাজিস্ট্রেট সুমাইয়া বেগমের আদালতে রোববার জামিন শুনানীর জন্য দিন ধার্য করা আছে। আমিসহ অ্যাডভোকেট কাজী সাজ্জাদ ইসলাম লিটন, সাইদুর রহমান সুমনসহ কয়েকজন আইনজীবী আদালতের নিকট এসব কৃষকের জামিন আবেদন পেশ করবো। জামিন হবে কি-না তা বিজ্ঞ আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন।

শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ জানান, রোববার এ বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ১৩ কৃষককে জামিনে মুক্তি না দিলে আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবো।