- সারাদেশ
- বাধাহীন কুমিল্লায় বড় সমাবেশ বিএনপির
বাধাহীন কুমিল্লায় বড় সমাবেশ বিএনপির

কুমিল্লায় গণসমাবেশে বক্তৃতা রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর- সমকাল
আগের বিভাগীয় গণসমাবেশে পরিবহন ধর্মঘট, হামলা ও বাধা থাকলেও শনিবার কুমিল্লায় নির্বিঘ্নে বড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। কর্মসূচির আগে মামলা ও গ্রেপ্তারও খুব একটা হয়নি। কুমিল্লায় ছিল না আওয়ামী লীগের পাহারা-মহড়াও। পুলিশের তল্লাশিও চোখে পড়েনি। ধীরগতি থাকলেও সচল ছিল ইন্টারনেট।
তবে বাধার আশঙ্কায় দু'দিন আগে থেকেই কুমিল্লার টাউনহল মাঠে জমায়েত হন বিএনপির নেতাকর্মীরা। শনিবার সকাল ১১টায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। তবে সমাবেশস্থল আগে থেকেই পূর্ণ ছিল নেতাকর্মীতে। কুমিল্লা কান্দিরপাড় সড়কের পূবালী চত্বর পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায় জমায়েত।
আগের রাতে সমাবেশের মাঠে তাঁবুতে থাকেন হাজারো নেতাকর্মী। গান-বাজনাতে রাত কাটান অনেকে। বৃহস্পতিবার থেকে টাউনহলে চলে খাওয়া ও রান্নাবান্না। শনিবার সকালে কুমিল্লার নানা প্রান্ত থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন রংবেরঙের টি-শার্ট, টুপি পরিহিত বিএনপির নেতাকর্মীরা।
নিজ দলের সমাবেশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমাবেশ তুলনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'সরকারি সব সুবিধা নিয়ে পরশু (বৃহস্পতিবার) তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) যশোরে সমাবেশ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ আপনার বিদায় দেখতে চায়। মানে মানে বিদায় নিন।'
কুমিল্লার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ আবারও ফন্দিফিকির করছে আগের মতো নির্বাচন করতে। অবৈধ প্রধানমন্ত্রী যশোরে সমাবেশ করে নৌকায় ভোট চেয়েছেন। কিন্তু সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগের জামানত থাকবে না। এ ভয়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে চাইছে। কিন্তু জনগণ তা হতে দেবে না।
বিএনপির সমাবেশ চলাকালে জেলা ও মহানগর কার্যালয়ে অবস্থান করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী মজিবুল হক বলেন, বিএনপিকে কোথাও বাধা দেওয়া হয়নি।
তবে কুমিল্লার বাইরে মুরাদনগর, ইলিয়টগঞ্জ, বাঙ্গোরা, লাকসাম, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, চৌমুহনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাখরাবাদে অটোরিকশা পর্যন্ত চলতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। মুরাদনগর থানা যুবদলের সদস্য সচিব সৈয়দ হাসান আহমেদ জানান, কোম্পানীগঞ্জ থেকে আসার পথে হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। যাঁরা সমাবেশে এসেছেন, তাঁদের দেখে নেওয়া হবে বলে পাড়া-মহল্লায় শাসানো হচ্ছে।
সমাবেশের সময় মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের উপস্থিতি। পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পূবালী চত্বরসহ আশপাশের ভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বিএনপির নেতাকর্মীকে বহনকারী একটি গাড়িও কুমিল্লায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়নি।
পরিবহন ধর্মঘট না থাকায় বিএনপির কর্মীরা বাস রিজার্ভ করে কুমিল্লায় আসেন; যা বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ফরিদপুর ও সিলেটের সমাবেশে ছিল অকল্পনীয়। বিএনপি নেতারা জানান, অর্থনীতির 'লাইফলাইন' খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কুমিল্লার ওপর দিয়ে গেছে। ধর্মঘট হলে আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত হতো। সরকার উল্টো চাপে পড়ত। তাই ধর্মঘট ডাকেনি।
শুক্রবার বিকেলে চাঁদপুর থেবে কুমিল্লার সমাবেশে আসা মো. শাহজালাল জানান, পিকআপে এসেছেন। শীতের রাত সমাবেশস্থলের মাঠে কাটিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, আওয়ামী লীগের নেতাদের মিথ্যা মামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন। দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়িতে থাকতে পারেন না। কিন্তু আর ভয় পান না, যা হওয়ার হবে।
হাজীগঞ্জ ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমাম হোসেন ক্রাচে ভর করে সমাবেশে আসেন। তিনি জানালেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পায়ে গুরুতর জখম হয়েছে। সবাই নিষেধ করেছিল, কিন্তু দলের মায়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এসেছেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, কর্মীদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের ছাত্রদল নেতা রফিকুল ইসলাম নয়ন মিয়াকে গণসমাবেশের লিফলেট বিলি করায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সমাবেশে নয়নের বাবার চোখে যে আগুন দেখতে পেয়েছি, তা দেশের মানুষের চোখেও জ্বলছে।
২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার লাকসাম থেকে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা হুমায়ূন কবির পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবির রাতুল ও সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফা ইসলামও সমাবেশে কথা বলেন। তাঁরা তাঁদের বাবাকে ফিরে পেতে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান। নয়নের বাবা রহমাতউল্লাহ হত্যার বিচার চেয়েছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, যেমন খুশি তেমন ভোট করতে আবারও গায়েবি মামলা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে মামলায় ফাঁসাতে মিথ্যাচার করছে সরকার। তাদের লজ্জাও নেই। এরা বেহায়া।
সরকারকে হুঁশিয়ার করে ফখরুল বলেন, যতই গায়েবি মামলা হোক, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ হবেই। সরকার পূর্বাচল, ইজতেমার মাঠে মহাসমাবেশের জায়গা দিতে চেয়েছিল। সেখান থেকে যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এসেছে, তখন নয়াপল্টনও আসবে। নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে।
অর্থনৈতিক সংকট, রিজার্ভের টাকা, সুশাসনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব। 'রিজার্ভের টাকা কেউ চিবিয়ে খায়নি'- প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাবে বলেন, চিবিয়ে নয়, রিজার্ভ গিলে ফেলেছে। গত ১০ বছরে ৮৬ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেরই ৭৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মির্জা ফখরুল আবারও বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। তাঁকে পদত্যাগ করে সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, হত্যা, গুম, খুন, মিথ্যা মামলায় বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চায় সরকার। ডিসেম্বরে সরকারকে বিদায় করার কর্মসূচি শুরু হবে। মেঘনা নদীর নামে বিভাগ করার সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এখন যে নামই রাখা হোক, বিএনপি ক্ষমতায় এলে কুমিল্লার নামে বিভাগ হবে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা আগুনঝরা চোখ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। সফল হবেই।
অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেখুন; জনগণ আওয়ামী লীগকে চায়, নাকি খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে চায়।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিস্কার হওয়া মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সারও হাজারো অনুসারী নিয়ে সমাবেশে আসেন। তবে মঞ্চে জায়গা হয়নি তাঁদের। সাক্কু বলেছেন, ঘোষণা দিয়েছিলাম আসব, এসেছি। আমি বিএনপির লোক। দলে ফিরতে তারেক রহমানের কাছে আবেদন করেছি।
নেতাকর্মী হত্যা ও নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে গত ১২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছে বিএনপি। কুমিল্লায় ছিল অষ্টম সমাবেশ। দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আমিন উর রশিদের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন ও মহানগর সদস্য সচিব ইউসুফ মোল্লার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তৃতা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়াসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।
মন্তব্য করুন