- সারাদেশ
- সেই 'সবুজ সংকেত' আর জ্বলল না
সেই 'সবুজ সংকেত' আর জ্বলল না

কুমিল্লায় বিএনপির সাংগঠনিক বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে আলোচনায় ছিলেন দলের দুই বহিস্কৃৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় দুই জনই দল থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন। বলা হয়েছিল, সমাবেশের আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁদের দলের ফিরিয়ে নেওয়ার 'সবুজ সংকেত' দিয়েছেন। তাঁরা মঞ্চে উঠবেন- এমন গুঞ্জনও ছিল দলীয় ফোরামে। সমাবেশের আয়োজকদের ধারণাও ছিল তাই। কিন্তু সেই সবুজ সংকেত আর আসেনি। তাই মঞ্চেও তাঁদের স্থান হয়নি।
ফলে কুমিল্লায় একটি সফল সমাবেশ আয়োজনে বড় ভূমিকা রাখলেও দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো স্পষ্ট বার্তা না পাওয়ায় হতাশ এ দুই নেতা এবং তাঁদের অনুসারীরা। তবে বেশি বেকায়দায় সাক্কু।
দলের ফেরার আশায় সমর্থকদের নিয়ে শনিবার সমাবেশের দিনেও মাঠে ছিলেন বহিস্কৃৃত দুই নেতা। সাক্কু ছিলেন মাঠের পূর্ব পাশের বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মুক্ত মঞ্চে; আর নিজাম ছিলেন কর্মীদের সঙ্গে সমাবেশ মঞ্চের সামনে। বিএনপি নেতাকর্মী বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তাঁদের দলে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর বিএনপি দুই ধারায় বিভক্ত। বর্তমানে এ দুই ইউনিটে বিএনপির মূলধারার নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। অপর পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) দুইবারের সাবেক মেয়র সাক্কু। গত জুনের সিটি নির্বাচনের সময় বহিস্কার হওয়ার আগে তিনি ছিলেন দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। অপর মেয়র প্রার্থী নিজাম ছিলেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। তিনি হাজি ইয়াছিনের শ্যালক।
বিএনপির স্থানীয় প্রবীণ নেতারা জানান, বিএনপি নেত্রী রাবেয়া চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী (প্রয়াত) কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের বিরোধের মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে কুমিল্লা জেলা দক্ষিণ বিএনপিতে প্রথম কোন্দলের সূত্রপাত। ২০০৬ সালে আকবর হোসেন মারা যান। সাক্কু আকবরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। নানা ঘটনার পর ২০০৯ সালে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সম্মেলনে সাক্কু দলের শীর্ষ পদ পাননি। ওই সম্মেলনে রাবেয়া চৌধুরী সভাপতি ও হাজি ইয়াছিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সাক্কুকে দেওয়া হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। এর পর থেকে কমিটি গঠন নিয়ে সাক্কু ও ইয়াছিনের গ্রুপিং চরম আকার ধারণ করে।
এর পর থেকে একাধিক সংসদ নির্বাচন, যুবদলের সম্মেলন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি, হরতাল, মিছিল-সমাবেশে তাঁরা এক মঞ্চে বসেননি।
২০১২ সালে কুসিকের প্রথম নির্বাচনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নাগরিক সমাজের ব্যানারে প্রথম এবং ২০১৭ সালে বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হন সাক্কু। গত জুনের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করে সাক্কু ও নিজাম উভয়েই পরাজিত হন। বিজয়ী হন নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত।
সাক্কু ও তাঁর সমর্থকরা পরাজয়ের জন্য নিজামকে দায়ী করেন। সদ্য ঘোষিত দক্ষিণ জেলা ও মহানগরী বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে ইয়াছিন গ্রুপের প্রাধান্য দেখা গেছে। এতে সাক্কুর অনুসারীদের কোণঠাসা করার অভিযোগ ওঠে। তাই দলে বিরোধ ও টানাপোড়েন আরও তীব্র হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। সমাবেশ ঘিরে উভয় গ্রুপে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও করেছিল দলের তৃণমূল। তবে সম্মেলন ছিল নিরুত্তাপ।
সাক্কু বলেন, 'বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে ১১ নভেম্বর থেকে সমাবেশের দিন পর্যন্ত কাজ করেছি। ছুটে গিয়েছি মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ড ও উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে। দুই দিন আগে থেকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আসা কর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠের এক পাশে কর্মীদের নিয়ে অবস্থান করেছি।' দলে ফেরার বিষয়ে সাক্কু বলেন, 'আমি দলের বাইরে নই। শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়াকে ভালোবেসে এ দলে আছি; ভবিষ্যতেও থাকব। সমাবেশের তারিখ ঘোষণার পর দলের মহাসচিব বলেছেন মাঠে কাজ করতে। তাই করেছি। কখন দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে- এ নিয়ে ভাবছি না। এটা দলের সিদ্ধান্তের বিষয়।'
নিজামের সঙ্গে বিরোধ প্রসঙ্গে সাক্কু বলেন, 'তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিরোধ তেমন একটা নেই। এসব বিরোধ জাতীয় নির্বাচনের আগে শেষ করা সম্ভব। কিন্তু এ পরিবারের সঙ্গে এখন আমার ব্যক্তিগত বিরোধ রয়েছে। তাদের হিংসা, শক্রতা ও বিরোধিতার কারণে আমি সিটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছি। আমার মনে হয়, নৌকাকে নিশ্চিত বিজয়ী করতেই চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজাম প্রার্থী হয়েছিলেন। না হলে আমি নিশ্চিত বিজয়ী হতাম।'
নিজাম বলেন, 'দল থেকে বহিস্কৃৃত হলেও সমাবেশ সফল করতে মাঠে কাজ করেছি। সমাবেশের দিন হাজার হাজার কর্মীর জন্য পানি ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছি। সাক্কুর সঙ্গে বিরোধ প্রসঙ্গে নিজাম বলেন, 'সাক্কু দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালে দলীয় প্রতীকে মেয়র হয়ে দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। পা ছুঁয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করেছেন। দলীয় কোনো সভা-সমাবেশে অংশ নেননি। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ কমিয়ে দেন। তাই আগেই তাঁকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ থেকে বহিস্কার করা হয়।'
সাক্কুর বিপরীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে তিনি বলেন, 'দলের নেতাকর্মীর অনুরোধে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি; সাক্কুকে পরাজিত করতে নয়।' কায়সার আরও বলেন, 'দলের প্রতি আস্থা থাকলে সাক্কু আগাম মনোনয়ন নিয়ে দর কষাকষি করতে জাপা চেয়ারম্যানের অফিসে যেতেন না। মিডিয়ায় এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে।' দলে ফেরা বিষয়ে তিনি বলেন, 'এটা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও পলিসির বিষয়। হয়তো সময় লাগবে।'
গ্রুপিং প্রসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) মোস্তাক মিয়া সমকালকে বলেন, নেতাকর্মী ঐক্যবব্ধ- কুমিল্লার সমাবেশই তাই প্রমাণ করেছে। সমাবেশ সফল হয়েছে। তিনি বলেন, 'দুই গ্রুপে বিরোধ থাকলে তো মাঠে পিটাপিটি হতো; রক্ত ঝরত। ইয়াছিন ও সাক্কু গ্রুপে হয়তো সামান্য মতবিরোধ থাকতে পারে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামীতে নির্বাচন হলে এসব মতবিরোধ শেষ করে নিতে পারব ইনশাআল্লাহ।'
মন্তব্য করুন