- সারাদেশ
- দেশব্যাপী ২৩২১ অভিযান গ্রেপ্তার ১৩৫৬
ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ
দেশব্যাপী ২৩২১ অভিযান গ্রেপ্তার ১৩৫৬

ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে সারাদেশে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩৫৬ জনকে। ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে গত ৪ দিনে রাজধানীতে ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকার সব এলাকার হোটেল ও মেসেও দফায় দফায় যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন টিম।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পুরোনো নাশকতার মামলায় এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামিদের গ্রেপ্তারে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত নেতাদের তালিকাও পুলিশের হাতে রয়েছে। শুধু রাজনীতিতে চারশর বেশি নেতার ওপর চোখ এখন গোয়েন্দাদের। তাঁদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তবে বিএনপি-জামায়াতের যেসব নেতার বিরুদ্ধে মামলা আছে তাঁদের অনেককে বাসায় পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া তাঁদের বেশিরভাগ নেতাকর্মী অ্যাপস ব্যবহার করে কথা বলছেন।
তাই প্রযুক্তিগত নজরদারিতে অনেকের গতিবিধি নিয়ে গোয়েন্দারা বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। এ কারণে ম্যানুয়াল সোর্সের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক বিভাগের ডিসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ অভিযান শুরুর পর ঢাকায় চেকপোস্ট ও টহল ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধে জড়াতে পারেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। তবে বিএনপির অভিযোগ, দলটির নেতাকর্মীকে টার্গেট করেই বিশেষ অভিযান চলছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। নির্দিষ্ট কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা মূল উদ্দেশ্য নয়। ডিসেম্বরে বিজয় দিবসসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিবসকে কেন্দ্র করেই বিশেষ অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২ হাজার ৩২১টি অভিযান চালানো হয়। মামলা হয়েছে ৩৫৮টি। এক সপ্তাহ আগে থেকে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের হালনাগাদ তথ্য পুলিশ সংগ্রহ করেছে। ১০ ডিসেম্বর ঘিরে বহুমাত্রিক নিরাপত্তার ছক নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে থেকেও ফোর্স আনা হতে পারে।
ফার্মগেট, গ্রিনরোড, কারওয়ান বাজার ও পল্টন এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোয় গিয়ে জানা যায়, কয়েকদিন ধরে নিয়মিতই সেখানে যাচ্ছে পুলিশের দল। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীকে খোঁজ করেছেন অভিযানকারীরা।
গ্রিনরোডের হোটেল সম্রাট আবাসিকের অভ্যর্থনা ডেস্কে কর্মরত ইমরান হোসেন সমকালকে জানান, কিছুদিন ধরে নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করেছে পুলিশ। নিয়মিত হোটেলে এসে অতিথিদের তালিকা পরীক্ষার পাশাপাশি কক্ষে গিয়ে তথ্য মিলিয়ে দেখছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া এবং পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কক্ষ ভাড়া দিতে নিষেধ করা হয়েছে। পলাতক দুই জঙ্গির ছবি দেখিয়ে জানতে চেয়েছে, তারা কখনও এসেছিল কিনা। এ ছাড়া কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানোর কথাও বলা হয়েছে।
একই এলাকার হোটেল গ্রিন প্যালেস ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক মো. নাঈম জানান, দু'দিন আগে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাত-আট সদস্যের একটি দল হোটেলে তল্লাশি চালায়। তারা হোটেলকক্ষে অবস্থানরত অতিথিদের তথ্য মিলিয়ে দেখেছে।
পল্টনের বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার হোটেল বন্ধু আবাসিকেও পরপর দু'দিন পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। হোটেলটির ব্যবস্থাপনায় যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশ গিয়ে জানতে চেয়েছে, বিএনপির নেতাকর্মী কেউ আছেন কিনা? তাঁরা বলেছেন, তেমন কেউ নেই। অতিথিরা সবাই ব্যবসায়িক কাজে এসেছেন। এরপরও পুলিশ তাঁদের তালিকা পরীক্ষা করে। একাধিক ব্যক্তির থাকা কক্ষে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ফরমে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য ও এনআইডি নম্বর মিলিয়ে দেখেছে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পার্কে-ফুটপাতে অবস্থান করা ভবঘুরে বা ভাসমান ব্যক্তিদের ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।
কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশের হোটেল ইনসাফের ম্যানেজার সামসুল আলম সমকালকে বলেন, দুইদিন আগে মতিঝিল থানা পুলিশ গিয়েছিল তাঁর হোটেলে। হোটেলে থাকা অতিথিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। রেজিস্টার খাতাও দেখেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ১০ ডিসেম্বরের ২-৩ দিন আগে থেকে হোটেল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ।
বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে পল্টন এলাকার 'হোটেল দ্য ক্যাপিটালে' তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার তোফাজ্জেল হক বলেন, ১০ ডিসেম্বরের আগে গ্রুপ ধরে অতিথি এলে তাঁদের কক্ষ ভাড়া দিতে নিষেধ করেছে পুলিশ। এ ছাড়া যে কোনো অতিথি এলে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ও জানতে বলা হয়েছে। একটি দলের নেতাকর্মীকে ভাড়া না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।
কাকরাইল এলাকার হোটেল ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনালে গত ২ ডিসেম্বর পল্টন থানা পুলিশ তল্লাশি করে। হোটেলটির ম্যানেজার হেমায়েত বলেন, যেসব কক্ষে অতিথি ছিলেন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন এসবই জানতে চান পুলিশ কর্মকর্তারা।
পল্টন এলাকার 'হোটেল বিজয়নগরে' ১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত তিন দিন রাতে পুলিশ তল্লাশিতে গেছে। পুলিশ হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত তারা হোটেলে অতিথিদের বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছেন। সন্দেহজনক কাউকে দেখলে পল্টন থানায় খবর দিতে বলা হয়েছে।
জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি ও চাঁদাবাজরা হোটেলে অবস্থান করতে পারে সন্দেহেও অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করে একাধিক আবাসিক হোটেলের কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনার কারণে কয়েক বছর তাঁরা ব্যবসা করতে পারেননি। এর মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় হোটেলে চালানো হচ্ছে অভিযান। আতঙ্কে সাধারণ অতিথিরাও হোটেলমুখী হবেন না বলে আশঙ্কা তাঁদের।
গাবতলীর আবাসিক হোটেল আরিফের স্বত্বাধিকারী আফসার হোসেন জানান, গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন দু'বার করে পুলিশের ৫-৬ জন সদস্য হোটেলে এসে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তাঁরা হোটেলের রেজিস্টার দেখছেন। হোটেলে অবস্থানকারী অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গত ৫ দিনে সারাদেশে বিএনপির ১ হাজার ৩১ নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের আগে নেতাকর্মীর মনোবল দুর্বল করতে এরই মধ্যে সারাদেশে গায়েবি মামলা দিতে শুরু করেছে। দুই শতাধিক মামলায় অন্তত ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। প্রত্যেক জেলা, মহানগর, থানা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে এ মামলার আসামি করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে প্রত্যেক দিনই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকার রাজধানীতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, বাসা-বাড়ি ও মেস এলাকায় গত শনিবার থেকে অভিযান চললেও অন্যান্য জায়গায় আরও অনেক আগে থেকেই এ অভিযান শুরু হয়েছে।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, বিএনপি নেতাদের না পেয়ে অনেক স্থানেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আত্মীস্বজনকে পর্যন্ত আটক করা হচ্ছে। বাসা-বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শনিবার রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে না পেয়ে তার শ্যালক আব্দুর রহমান সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। সোহেলের ঘনিষ্ঠজন জানান, কিছুদিন আগে তাঁর চোখে অপারেশন হয়েছে। তিনি ভীষণ অসুস্থ। কিন্তু পুলিশের অভিযানকে মাথায় রেখে তিনি অন্যত্র গিয়ে থাকছেন।
একই রাতে ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাকের গুলশানের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ। ওই সময় বাসায় কেউ ছিলেন না। বাসার সামনে ১২টা পর্যন্ত পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রাখলেও পরে বাসার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ করেন আশফাক।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি নেতাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরা কী দোষ করেছেন? তাঁরা তো রাজনীতি করেন না।
যুবদলের সভাপতি টুকু রিমান্ডে: পল্টন থানার পুরোনো নাশকতার মামলায় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ সাতজনের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিন রোববার এই আদেশ দেন। রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশ থেকে ফেরার পথে গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর আমিনবাজার এলাকা থেকে সুলতান সালাউদ্দিনকে আটক করে। গত মে মাসে পল্টন থানায় দায়ের করা নাশকতার মামলায় সুলতানসহ সাতজনকে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। এদিকে রমনা থানার পৃথক আরেক মামলায় যুবদল নেতা টুকু ও বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়চৌধুরীসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
৭৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা: নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম মওলা শাহীনসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৫ নেতাকর্মীর নামে মামলা করেছে পুলিশ।
মন্তব্য করুন