২০০১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে শ্রমিক হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে যোগদান করেছিলেন মফিজ মিয়া। গত অক্টোবরে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২২ বছর চাকরির পর শূন্য হাতে ফিরেছেন তিনি। থাকতেন নগরের টাইগারপাস এলাকায়। চাকরি হারিয়ে পরিবার নিয়ে তিনি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, 'এত বছর চাকরি করলাম; একটা টাকাও পেলাম না! শেষ মাসের বেতনও দেয়নি। বউ-ছেলে নিয়ে শহরে থাকতে না পেরে গ্রামে চলে এসেছি।' প্রকৌশল বিভাগে প্রায় ৩৫ বছর চাকরি করেছেন মিলন সেন; একই বিভাগে চালক হিসেবে চাকরি করেছেন দৌলত খান। তাঁরাও ফিরেছেন শূন্য হাতে।

শুধু মফিজ, মিলন বা দৌলত খান নন; এক নোটিশে অস্থায়ী ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছে চসিক, যাঁরা ২০ থেকে ৩৫ বছর প্রতিষ্ঠানটিকে সেবা দিয়েছেন। অস্থায়ী হওয়ায় অবসরোত্তর কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি তাঁরা। চাকরি হারিয়ে অনেকে অর্থাভাবে শহর ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন গ্রামে। চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন অস্থায়ী আরও ছয় হাজার কর্মচারী, যাঁদের তালিকা তৈরি করতে ইতোমধ্যে চিঠি জারি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন তাঁরা। তবুও অদৃশ্য কারণে স্থায়ী হচ্ছে না চাকরি। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাবি- কোনো জটিলতা নেই। মন্ত্রণালয়ও স্থায়ী করতে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে অসাধু কর্মকর্তারা বিদ্যমান কর্মচারীদের স্থায়ী করতে আগ্রহী নন।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৯৮৮ সালে অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে পদ ছিল ৩ হাজার ১৮০টি। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪৬ পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে সিটি করপোরেশনে পদসংখ্যা ৪ হাজার ২২৬। এর বিপরীতে সিটি করপোরেশনের স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৮ হাজার ৮০৩ জন। এদের মধ্যে ৬ হাজার ৩৩ জনই অস্থায়ী।

বাধা নেই, তবু আটকে স্থায়ীকরণ :নতুন পদ সৃষ্টি হওয়ার পর ২০২০ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি শূন্য পদে লোক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিটি করপোরেশন। এতে অস্থায়ী কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। তাঁদের বাধার মুখে নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী করতে সচিব খালেদ মাহমুদকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে সিটি করপোরেশন। কমিটি ২০২১ সালের ৩ আগস্ট সভা করে। সভায় সিটি করপোরেশনের তৎকালীন আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন আইনি ব্যাখা তুলে ধরেন। তাতে বলা হয়, করপোরেশনের যেসব অস্থায়ী কর্মচারী তাঁদের চাকরি স্থায়ী করতে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন, তাঁরা সবাই জয়ী হয়েছেন। সব অস্থায়ী কর্মচারীর নিয়োগ এবং চাকরি বৃত্তান্ত প্রায় এক হওয়ায় অন্যরাও আদালতে গেলে একই রকম রায় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষিত :সিটি করপোরেশনের শূন্য পদ পূরণে জটিলতা বিষয়ে গত ২৪ এপ্রিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে সভা আহ্বান করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর সভাপতিত্বে সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যমান জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া, যোগ্যতা, বয়স ইত্যাদি পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সংশ্নিষ্ট বিদ্যমান আইন ও চাকরি বিধিমালার আলোকে শূন্য পদ পূরণ ও অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এর পর ৮ মাসেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছেন না কর্মকর্তারা :সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের অভিযোগ, আইনি কোনো বাধা নেই। সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগও দিয়েছেন নির্দেশনা। এর পরও ছয় হাজার অস্থায়ী কর্মচারীর চাকরি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের একাংশ। সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর সাধারণ সভায় অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী করার দাবি তোলেন সিটির কাউন্সিলররা। তাতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও সম্মতি দেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আটকে আছে স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া।

সাধারণ সভায় অংশ নেওয়া সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বলেন, 'একেকজন অস্থায়ী কর্মী ২০-২৫ বছর ধরে চাকরি করছেন। অনেক কর্মীকে খালি হাতে বিদায় নিতে হয়েছে। বিষয়টি খুবই অমানবিক। স্থায়ীকরণের দাবি বারবার উঠলেও নানা নিয়মনীতির অজুহাতে তা পূরণ হচ্ছে না।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম সমকালকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন কি নিয়োগ দেওয়ার সময় বলেছিল- তাদের স্থায়ী করবে? যারা কোনো জায়গায় চাকরি পায় নাই, তারাই এখানে এসে চাকরি করেছে। না হলে অস্থায়ী চাকরি এত বছর ধরে করবে কেন? আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী স্থায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।'

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শ্রমিক ও কর্মচারী লীগের (সিবিএ) সভাপতি ফরিদ আহমদ সমকালকে বলেন, 'প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেঁকে বসায় অস্থায়ীদের চাকরি স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া আটকে আছে। তিনি বলছেন, সিটি করপোরেশনের বিধিবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি- বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থায়ী না করে সিটি করপোরেশনে কোনো নতুন নিয়োগ দেওয়া যাবে না।'