ডায়ার মিলের দাপট ও লোকসানের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে কয়েক বছরে বন্ধ হয়েছে শতাধিক হাসকিং রাইস মিল ও চাতালকল। যেগুলো চালু আছে তাও কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধের ঝুঁকিতে আছে। আধুনিক প্রযুক্তির ডায়ার মিলে বেশি উৎপাদন, ভোক্তাদের কাছে মিলের চালের চাহিদা, সরকারি সংগ্রহে প্রাধান্য ও লোকসানের কারণে চাতালকল সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। এতে কাজ হারানোর শঙ্কায় দিন গুনছেন ১০-১২ হাজার শ্রমিক। এভাবে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ডায়ার মালিকের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া আশঙ্কা অনেকের।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর কয়েকজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে আশুগঞ্জের চরচারতলা ও সোহাগপুরে ২-৩টি চাতালকল চালু হয়। এতে লাভবান হওয়ায় পরে আলমনগর, বাহাদুরপুর, দুর্গাপুর, কামাউরা, খড়িয়ালা ও বইগর এলাকায় গড়ে ওঠে তিন শতাধিক চাতালকল। এটি বনেদি ব্যবসায় পরিণত হয়। বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ কাজের সুযোগ পান। 'কাজ নেই, মজুরি নেই' চুক্তিতে দাদন বা অগ্রিম শ্রম বিক্রি করে চাতালে কাজ শুরু করেন তাঁরা। পরিবারসহ সেখানেই বসবাস শুরু করেন।

সংশ্নিষ্টরা জানান, গত ৮-১০ বছরে শতাধিক চাতাল পুরোপুরি বন্ধ ও অনেক বন্ধের পথে রয়েছে। অনেক মালিক পুঁজির অভাবে ও লোকসানের আশঙ্কায় চাতাল বন্ধ রেখেছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েকটি চাতালের স্থানে নতুন ডায়ার মিল, মার্কেট বা আবাসিক ভবন তৈরি হয়েছে। অনেক চাতালের মাঠে ঘাস গজিয়েছে।

চাতাল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা জানান, ডায়ার মিলে উৎপাদিত চাল দেখতে আকর্ষণীয় ও মরা দানাবিহীন। অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ হলেও চাতালের চালে ধানের কিছু মরা দানা থাকা, রং বিবর্ণ হওয়া ও দেখতে আকর্ষণীয় না হওয়ায় বাজারে চাহিদা কম। সরকারি চাল সংগ্রহ অভিযানে ডায়ার মিলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বৃষ্টি ও দুর্যোগে ব্যাহত হয় চাতালের উৎপাদন। ডায়ার মিলে এ সম্ভাবনা নেই। প্রতি মণ ধান থেকে চাতালে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন সম্ভব,ডায়ার মিলে তার চেয়ে অন্তত দুই কেজি বেশি হয়। এ কারণে চাতাল মালিকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে রয়েছেন।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি ডায়ার মিল প্রতিষ্ঠায় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। এত পুঁজি বিনিয়োগ অনেকের পক্ষে অসম্ভব। ৫-৭ জন মিলে ডায়ার মিল তৈরির উদ্যোগও নিচ্ছেন কেউ কেউ। ৭-৮ বছরে আশুগঞ্জে একক মালিকানায় ২৪টি ডায়ার মিল গড়ে উঠেছে। একক ও যৌথ উদ্যোগে আরও অন্তত ২০টি শিগগিরই উৎপাদনে আসবে। একটি ডায়ারের উৎপাদন ক্ষমতা ১৫-২০টি চাতালের সমান। অথচ শ্রমিক লাগে ১৩০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ জন। চাতালে গড়ে ২৫-৩০ জন শ্রমিক লাগে। একটি ডায়ার প্রতিষ্ঠা হলেই প্রায় আড়াইশ শ্রমিক বেকার হচ্ছেন।

শ্রমিক কাদির মিয়া বলেন, ১০-১২ বছর ধরে কাজ করলেও চাতাল বন্ধ হওয়ায় আশঙ্কায় তিনি উদ্বেগে রয়েছেন। নারী শ্রমিক আয়না বিবি ও রুবেনা বেগম বলেন, চাতাল বন্ধ হলে তাঁরা গার্মেন্টস বা মাটি কাটার শ্রমিকের কাজ করবেন। রাশেদা বেগম বলেন, মালিক চাতাল ভাড়া নিলেও পুঁজির অভাবে চালু করছেন না। তাঁর স্বামী রিকশা চালান। তাঁরা ঢাকায় চলে যাবেন। চাতালকল শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্বাস সর্দার বলেন, চাতাল বন্ধ হওয়ায় সামনে আরও অনেকে বেকার হবেন।

উপজেলা চাতালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল সিকদার বলেন, ডায়ার মিলের চাল চাতালের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মালিকরা টিকতে না পেরে চাতাল বন্ধ করছেন।

এ বিষয়ে আওলাদ অ্যাগ্রো ফুডের মালিক মো. আওলাদ হোসেন বলেন, তাঁর ডায়ার মিল তৈরিতে ৩১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চাতালের তুলনায় ডায়ার মিলের চাল অধিক টেকসই। এমবি অটো ডায়ার মিলের মালিক মো. মোবারক হোসেন বলেন, বাজারে ডায়ার মিলের চালের চাহিদা বেশি থাকায় চাতাল ব্যবসায়ীরা এতে ঝুঁকছেন।

উপজেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মিজানুর রহমান বলেন, এক সময় তিনিও চাতাল ব্যবসায় ছিলেন। লোকসান হওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছেন। চাতাল ব্যবসায় আছেন উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদও। তাঁর চাতালও বন্ধের পথে। তাঁদের আশঙ্কা, চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ কিছুদিন পর ডায়ার মিলারদের হাতে চলে যাবে।

এ বিষয়ে আশুগঞ্জ ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় চাতালগুলো মার খাচ্ছে। খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সোলাইমান মিঞা বলেন, ডায়ারের চালে মরা দানা কম ও চকচকে হওয়ায় সংগ্রহে প্রাধান্য দেওয়া হয়।