- সারাদেশ
- দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বনাশ তুষারের
দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বনাশ তুষারের

জায়গা বন্ধক, গৃহপালিত গাভী বিক্রি এবং এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তুষার আহাম্মেদ। কথা ছিল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পৌঁছেই ভালো কাজ পাবেন; পাবেন আকামাও। তবে এসবের কোনো ব্যবস্থাই করেনি দালাল। দুই মাস পালিয়ে থেকে এক পরিচিতজনের মাধ্যমে কাজ জোটান তুষার (২৮)। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মাসখানেকের মধ্যে ধরা পড়েন সৌদি পুলিশের হাতে। ২১ দিন জেল খেটে গত ১২ নভেম্বর দেশে ফেরেন। তবে এরই মধ্যে সর্বনাশ হয়ে গেছে তাঁর। ঋণের কিস্তির চাপে ২৩ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন তাঁর স্ত্রী শরিফা খাতুন। ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্র তৌসিক হয়েছে মা-হারা। সে সারাক্ষণ কাঁদে আর মায়ের খোঁজ করে।
সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর নির্যাতনেরও শিকার হন তুষার। শরীরজুড়ে এখনও অসহ্য যন্ত্রণা হয় তাঁর। অর্থাভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। এর ওপর ঋণের কিস্তির চাপও বাড়ছে। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর তুষার। তিনি উপজেলার তাহেরহুদা ইউনিয়নের গোপিনাথপুরের খন্দকার আব্দুল ওহাবের ছেলে।
গত মঙ্গলবার সকালে হরিণাকুণ্ডু থেকে আড়াই কিলোমিটার পশ্চিমে তাঁদের বাড়িতে দেখা যায়, দাদি রেবেকা খাতুনের কোলে বসে আছে তুষারের ছেলে তৌসিক। অপলক চোখ খুঁজছিল মায়ের ছায়া। দুই মাস হতে চললেও মাতৃশোক কাটাতে পারেনি অবোধ শিশুটি। রেবেকা বলেন, 'বাবা! কী করব? মা-মরা ছেলেটা সারাদিন শুধু কাঁদে। মায়ের কাছে যেতে চায়। কীভাবে এই অবুঝ শিশুকে বোঝাব যে তাঁর মা বেঁচে নেই!'
রেবেকা আরও বলেন, 'পরের ক্ষেতে কাজ করে ছেলেটা সংসার চালাত। দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে এখন আমরা নিঃস্ব। সমিতির লোক এসে কিস্তির জন্য বাড়িতে বসে থাকত। চাপ আর অভাব সইতে না পেরে বৌমা বাবার বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এখন কার কাছে যাব, মা-মরা শিশুকেই বা কীভাবে লালন-পালন করব? একমাত্র ছেলেটাও অসুস্থ। তাঁর চিকিৎসা আর ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করব'- বলতে বলতে কেঁদেই ফেলেন তিনি।
ঘরের বারান্দার বিছানায় শুয়ে তুষার বলেন, নিজের এক বিঘা জমি বন্ধক। গাভী বিক্রি এবং ব্র্যাক থেকে ২ লাখ টাকা ঋণ নেন বিদেশ যাওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দেন একই উপজেলার ফলসী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মনিরুল ইসলামকে। কিন্তু গত ২৫ মে সৌদি আরব গিয়ে বুঝতে পারেন তাঁকে ভুয়া ভিসা দেওয়া হয়েছে। ভালো কাজ দেওয়ার কথা হলেও কাজ মেলেনি। আকামাও দেওয়া হয়নি। দুই মাস লুকিয়ে লুকিয়ে থাকেন। পরে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে একটি কাজ জোগাড় হয়। মাসখানেক কাজ করার পরই ধরা পড়েন সৌদি আরবের পুলিশের হাতে। ২১ দিন আটক থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হন। অবশেষে ১২ নভেম্বর দেশে ফেরেন। ফলসী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি)
প্যানেল চেয়ারম্যানেরও দায়িত্বে আছেন তুষারকে সৌদি আরব পাঠানো মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'আমি তুষারকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে সে কাজ না করে চলে এসেছে।' তাঁকে আকামা দেওয়ার বিষয়ে দাবি করেন, 'আকামা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তার আগেই সে চলে আসে।' রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠান তিনি।
মনিরুল ইসলামের দাবি অস্বীকার করেন তুষার। তিনি বলেন, সৌদি আরব পৌঁছে মনিরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাননি। তাঁর কোনো লোকও সেখানে ছিল না। দেশে ফিরেও অনেকবার তাঁর মোবাইল ফোনে কল দিয়েছেন, তিনি ধরেননি।
স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আদম ব্যাপারীর খপ্পরে পড়ে পরিবারটি এখন দিশেহারা। একই দালালের খপ্পরে পড়ে এ গ্রামের আরও কয়েকজন বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দ্রুত এমন দালালদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহা বলেন, 'আমরা বৈধভাবে বিদেশে যেতে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায়ই মানুষকে সচেতন করি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
মন্তব্য করুন