গহিন পাহাড়ের ঢালে গেল রোববার বিকেলে মাছ ধরতে যান নূর মোহাম্মদ। সেখান থেকেই তাঁকে তুলে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড জাহাজপুরা পাহাড়ের ছড়া থেকে শিক্ষার্থীসহ যে আটজনকে অপহরণ করা হয়, এর মধ্যে আছেন নূর মোহাম্মদও। তিন দিনেও তাঁদের খোঁজ না মেলায় বাড়ছে স্বজনের মধ্যে উৎকণ্ঠা। এক এলাকা থেকে এক সঙ্গে আটজনকে অপহরণের ঘটনা এটাই প্রথম।

ঘটনার পর কয়েকজনের পরিবারের স্বজনের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেছে অপহরণকারীরা। এটা জানাজানির পর স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টেকনাফের তিনটি পাহাড় ঘিরে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। ড্রোন উড়িয়ে অপহরণকারীদের আস্তানা ও অপহৃত ব্যক্তিদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে জেলা পুলিশ। তবে গতকাল রাত পর্যন্ত অপহৃত কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে তল্লাশি কার্যক্রম চলছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, অস্ত্রধারীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী হতে পারে। তবে এলাকাবাসী অপহরণকারীদের রোহিঙ্গা ডাকাত বলে সম্বোধন করে। অপহৃত রা হলেন- বাহারছডা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাজপুরা এলাকার রশিদ আহামদের ছেলে মোহাম্মদ উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে মোস্তফা কামাল, মমতাজ মিয়ার ছেলে মো. রিদুয়ান, রুস্তম আলীর ছেলে সেলিম উল্লাহ, ছৈয়দ আমিরের ছেলে করিম উল্লাহ, কাদের হোসেনের ছেলে নুরুল হক ও নূর মোহাম্মদ এবং রশিদ আহমদের ছেলে শিক্ষার্থী আবছার।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি পাহাড়ের ওপর ড্রোন উড়িয়ে অপহরণকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জঙ্গলে বড় ও ঘন গাছগাছালির কারণে ড্রোন থেকে স্পষ্ট কিছু এখনও ধরা পড়েনি। স্বজনের পক্ষ থেকেও মামলার প্রস্তুতি চলছে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য অপহৃত দের উদ্ধার করা। এর পর কেন, কারা, কী কারণে তাঁদের অপহরণ করেছে, তা বিশদভাবে তদন্ত করে দেখব।
অপহৃত নূর মোহাম্মদের শ্বশুর মো. সাইফুল্লাহ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেন, 'ঘটনার পর থেকে ভয়ে আছি। বাড়ি থেকেও তেমন একটা বের হই না। মেয়েও শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার কাছে চলে এসেছে। মেয়ে আর ছোট্ট নাতনিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই। আমরা গরিব। চাইলেই তো টাকা দিয়ে অপহরণকারীদের কাছ থেকে নিয়ে আসতে পারুম না। দিনরাত বলতে গেলে নির্ঘুম কাটাচ্ছি।'

অপহৃত রিদুয়ানের বাবা মমতাজ বলেন, 'অপহরণকারীরা ফোন করে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় আছি। বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না।'
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসার (আগের নাম আল-ইয়াকিন) নাম ব্যবহার করে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। আবার এর সঙ্গে কোনো কোনো বাঙালিও রয়েছে। এমনকি মাদক বা মানব পাচারের টাকার লেনদেন নিয়ে কোনো ঝামেলা তৈরি করেও এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে আটকে মুক্তিপণ দাবি করছে। গত এক মাসে বাহারছড়া এলাকায় সাত-আটটি অপহরণের ঘটনা ঘটে। তবে সব ঘটনার ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে যান না। অনেক সময় স্থানীয়রা দেনদরবার করে পণ দিয়ে স্বজনকে মুক্ত করেন।
টেকনাফে সদর থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরে বাহারছড়ার পাহাড়ি এলাকায় নোয়াখালীপাড়া। এর পাশেই মারিশবুনিয়া, ডেইলপাড়া, বাঘগুনা ও কোনাপাড়া। এসব এলাকায় অন্তত ২০ হাজার মানুষের বাস। তাদের বসতি অধিকাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে। হঠাৎ অপহরণের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গত ৩১ জুলাই সকালে ওই এলাকায় ইলিয়াছ ও সৈয়দ আহমদ নামে স্থানীয় দুই বাসিন্দাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এর আগের দিন নোয়াখালীপাড়ার মোহাম্মদ মুবিনুল ও মোহাম্মদ নুর নামে আরও দু'জনকে অপহরণের পর 'রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা' মুক্তিপণ দাবি করে। পরের দিন মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসেন তাঁরা।

স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ও মো. ইলিয়াছ বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এখন পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা 'নিরাপদ স্থান' হিসেবে বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকা ব্যবহার করছে। এ কারণে হঠাৎ করে মাদক পাচারসহ অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। অনেকে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছে।
টেকনাফের বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, 'অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ গ্রামের ২০ হাজারের বেশি মানুষ ভয়ে আছে।'

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ এক সঙ্গে যে আটজনকে অপহরণ করা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে কারও পূর্ববিরোধ ছিল কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। অনেকের স্বজনকে ডেকে পুলিশ কথাও বলেছে। অপহৃত দের আটজনের মধ্যে একজন মাদক মামলার আসামি। আবার আরেকজনের ভাই মানব পাচার মামলায় অভিযুক্ত।

টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। খুনাখুনি, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ অভিনব প্রতারণায় জড়িত নানা চক্র। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৮টি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ২২৬। এর মধ্যে অস্ত্র মামলা ১৮৫টি, মাদক মামলা ১ হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ মামলা ৮৮টি, হত্যা মামলা ১১৫টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩৯টি।
টেকনাফ থানার ওসি আব্দুল হালিম বলেন, অপহরণের ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।







বিষয় : পাহাড়ে ড্রোন উড়িয়ে তল্লাশি

মন্তব্য করুন