চলমান ডলার সংকটে চাহিদামতো পাথর আমদানিসহ পাথরের এলসি দিতে না পারায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে। এতে দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় এ স্থলবন্দরে ১০ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে আগের দেওয়া এলসির কারণে পাথরসহ অন্যান্য পণ্য সীমিতভাবে আমদানি ও রপ্তানি হচ্ছে। তবে পাথরনির্ভর এ বন্দরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাথর আমদানি না হওয়ায় দেখা দিয়েছে এই স্থবিরতা।

অবস্থানগত কারণে বাংলাবান্ধা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর। এখান থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের অবস্থান বেশ কাছাকাছি। বাংলাবান্ধা থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়া বাংলাবান্ধা থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শহরের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার এবং নেপালের কাকরভিটার দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার ও ভুটানের জয়গা সীমান্তের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার। চতুর্দেশীয় এ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারে ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী স্থলবন্দরের জন্য উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে নেপালের মধ্যেও শুরু হয় পণ্য আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য। এর পর পাথরসহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হয় ভুটান। এর পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের বিভিন্ন পণ্য আনা-নেওয়া শুরু। তবে অন্য পণ্যের তুলনায় ভারত ও ভুটান থেকে পাথর আমদানি হয় সবচেয়ে বেশি। এক সময় এ বন্দর দিয়ে ভারত ও ভুটান থেকেই প্রতিদিন গড়ে আট হাজার টন পাথর আমদানি করা হয়। শুধু পাথর আমদানির কারণেই স্থলবন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য জমে ওঠে।

সরকারি বিধিনিষেধে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্থানীয়ভাবে পাথর আমদানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় এ এলাকা হয়ে ওঠে পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের উর্বর আয়ের উৎস। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা পাথরের কারণে এখানে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও পরিবহনের মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও নির্মাণ ঠিকাদাররা এখান থেকে পাথর নিয়ে যান। বর্তমানে এ পাথরের সঙ্গে বন্দরের কুলি শ্রমিক, লোড-আনলোড শ্রমিক, পাথর ভাঙা শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ ২০ হাজারের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বন্দর দিয়ে চাল, গম, ভুসি, ভুট্টাসহ খাদ্য ও জরুরি পণ্য আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু চলমান ডলার সংকটের কারণে জরুরি পণ্য বাদে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে পাথর আমদানির জন্য কোনো ব্যাংকে এলসি খোলা হচ্ছে না। পাথরের জন্য আগের করা এলসিতে সীমিত পরিসরে পাথর আমদানি করা হচ্ছে। এসব পাথর আমদানি শেষ হলে কবে নাগাদ আবারও পাথর আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলা যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে কর্মহীনতার আতঙ্কে রয়েছেন স্থলবন্দরের শ্রমিকসহ ব্যবসায়ীরা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের লোড-আনলোড শ্রমিক ইদ্রিস আলী বলেন, ভারত ও ভুটান থেকে আসা পাথর দিয়েই আমাদের স্থলবন্দর জমজমাট থাকত। এখন আর আগের মতো পাথর আসে না। এক সময় আমরা কাজ শেষ করতে পারতাম না। এখন কাজের অভাবে সারাদিন বসে থাকি। যে পরিমাণে পাথর আসে, তা লোড-আনলোডে আমাদের সব শ্রমিক কাজ পান না। আমরা চাই, অন্য মালপত্রের সঙ্গে আগের মতো পাথর আমদানি করা হোক। তা না হলে সব মিলিয়ে আমাদের ১০ হাজারের মতো শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি ও রপ্তানিকারক মো. নাসিমুল হাসান নাসিম সমকালকে বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে ব্যাংকে পাথরের এলসি হচ্ছে না। এতে স্থলবন্দরের ৫০০ শ্রমিক এবং এর বাইরে ১০ হাজারের শ্রমিক প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এভাবে চললে শুধু শ্রমিক নন, আমদানি-রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ীসহ আমরা সবাই কর্মহীন হয়ে পড়ব।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুদরত-ই খোদা মিলন বলেন, চলমান ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে এলসি করতে পারছেন না। এ জন্য ঠিকমতো পাথর আমদানি হচ্ছে না।
পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হান্নান শেখ বলেন, এলসি খুলতে না পারায় পাথরের দামও অনেক বেড়ে গেছে। একজন ঠিকাদার হিসেবে পাথরের অভাবে আমি কয়েকটি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছি। এই বন্দর দিয়ে পাথরের এলসি খোলা না গেলে সরকারের চলমান উন্নয়নকাজ ব্যাহত হবে।

তবে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। আগের করা এলসির মাধ্যমে নিয়মিত পাথর আমদানি হচ্ছে। আমাদের পণ্য ভারতে রপ্তানি কমে গেছে। আমি শুনেছি, ডলার সংকটের কারণে জরুরি পণ্যের বাইরে কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের এলসি বন্ধ রয়েছে। এই সংকট দ্রুত কেটে যাবে বলে আশা করি।


বিষয় : বাংলাবান্ধা বন্দরে স্থবিরতা

মন্তব্য করুন