রিকশা চালিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন আসাদুল হক (৩৫)। থাকেন গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার উত্তর কাজীবাড়ী সন্তোলা গ্রামের বাড়িতে। পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও তিন সন্তান। একমাত্র উপার্জনক্ষম আসাদুল। মেয়ে মেঘলা আক্তার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বড় ছেলে রাতুল ইসলাম পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে, ছোট আব্দুর রহিম প্রথম শ্রেণির ছাত্র।

সংসারের খরচ সামলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ব্যয় চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে তাঁর। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে সন্তানদের বই-খাতা, কলমসহ শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দিনরাত এক করে রিকশা চালিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না আসাদুল। তাই ভাবছেন, চাপ কমাতে রাতুলকে আগামী বছর হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়তে পাঠাবেন। সামান্য খরচ দিলেই হয় সেখানে। সাধারণ পড়াশোনায় প্রাইভেট টিউটরের বেতন দেওয়ার ঝামেলা থাকবে না। তা না করলে অন্য দু'জনের পড়াশোনাও বন্ধ করে দিতে হবে।

আসাদুল বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাজারে গেলে মাথা গরম হয়ে যায়। কোনো দিন শরীর খারাপ করলে রিকশা নিয়ে বের হতে পারেন না। কোনো কোনো দিন স্ত্রী শেফালি বেগম কোনোভাবে চালিয়ে নিলেও, সব দিন তা আর হয়ে ওঠে না। সেদিন অভুক্ত থাকতে হয় গোটা পরিবারকে।

এ অবস্থায় শুধু আসাদুল হক একাই নন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাসামগ্রীর দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের বেশিরভাগ পরিবার। আর্থিক সংকটে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঝরে পড়ছে হাজারো শিশু।

সরকারের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় পরিচালিত হয় 'আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম'। ২০২০ সালে তাদের করা জরিপে জানা যায়, ওই বছর সাদুল্যাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়েছে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী ২ হাজার ৫৯২ শিশু। এদের মধ্যে বালক ১ হাজার ৩৪৪ জন, বালিকা ১ হাজার ২৪৮। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, এদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ পরিবারের আর্থিক অসংগতি। এ ছাড়াও বাল্যবিয়েসহ নানা কারণ রয়েছে।
ওই প্রোগ্রামের ম্যানেজার রাহেল ইসলাম বলেন, ঝড়েপড়া শিশুদের মধ্যে ২ হাজার ১০০ জনকে বিনামূল্যে লেখাপড়া করাচ্ছেন তাঁরা। তাদের আনা হয়েছে উপজেলার ৭০টি শিখন কেন্দ্রে। প্রশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ। রাহেল ইসলাম মনে করেন, এ উপজেলায় ঝরেপড়া শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও ২০২১ ও ২০২২ সালের তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
শহরের একটি দোকানে কাগজ কিনতে এসেছিলেন খাইরুল ইসলাম। উপজেলার ক্ষুদ্র রুহিয়া গ্রামের এ বাসিন্দা বলেন, তাঁর দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে কষ্ট করতে হচ্ছে। শিক্ষাসামগ্রীর দাম অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে। যে কারণে তাঁর মতো কৃষক পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ জন্য শিক্ষা উপকরণের মূল্য কমানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সাদুল্যাপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ গেট এলাকার কামাল লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন সরকার বলেন, এক বছরে শিক্ষা উপকরণের মূল্য একাধিকবার বেড়েছে। এর মধ্যে বইয়ের দামই বেড়েছে বেশি।

শহরের ডিগ্রি কলেজ এলাকার বাসিন্দা জামির হোসেনের ছেলে এইচএসসি পাসের পর এবার ভর্তি হয়েছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি)। এইচএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় থেকে কোচিং করতে হয়েছে তাঁকে। থাকা-খাওয়া, যাতায়াতসহ মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হয়েছে তাঁর। জামির হোসেন মনে করেন, সব পরিবারের পক্ষে এমন ব্যয় বহন সম্ভব নয়। একজন ভালো মানের শিক্ষার্থী তৈরির জন্য মেধা আর শ্রমের সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থেরও।

উপজেলার কৃষ্ণপুর মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, খাতা-কলম ও পোশাক না থাকার অজুহাতে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে আনতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয়। তাঁরা বিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া বার্ষিক স্লিপের অর্থ থেকে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীকে খাতা-কলম কিনে দেন। পাশাপাশি নানাভাবে সহায়তার চেষ্টা করেন।

শহরের পাবলিক লাইব্রেরি সংলগ্ন রহমানিয়া লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী সাইদুর রহমান বলেন, শিশুদের শিক্ষাসামগ্রীর দাম বাড়ায় ক্রেতার সংখ্যা কমছে। দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডাও হচ্ছে। তাঁদের কাছে এখন কম দামের কোনো জিনিসই বলতে গেলে নেই।

জামালপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলামের কথায় উঠে আসে আরেকটি গুরুতর বিষয়। তিনি বলেন, এমনিতেই গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর মধ্যেই শিক্ষা উপকরণসহ মেয়েদের পোশাক ও প্রসাধনীর দামও বাড়ছে। যে কারণে বিদ্যালয়ে তাদের উপস্থিতি কমে আসছে। অভিভাবকরা পছন্দসই পাত্র পেলে স্কুলপড়ূয়া মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। এক বছরে তাঁর বিদ্যালয়ের ২৫-৩০ মেয়েকে বসতে হয়েছে 'বাল্যবিয়ে'র পিঁড়িতে।

উপজেলা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি নেয়ামুল আহসান পামেল বলেন, নতুন বছরে বইসহ শিক্ষা উপকরণের দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন। যে কারণে অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।

তাঁর দাবি, উৎপাদনকারীরা আগাম নোটিশ ছাড়াই শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছর একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে দাম। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে বিক্রেতাদের ঝগড়া লেগে যায়। কাগজের মূল্য কমিয়ে ভ্যাট ও শুল্ক্ক প্রত্যহারে সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিশ শাফি জানান, সাদুল্যাপুরের ১৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫ হাজার ৫৫০। এর মধ্যে শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাসে ৫০ টাকা, আর প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাসে ১৫০ টাকা করে উপবৃত্তি পায়। এ ছাড়া স্কুল ব্যাগ, জুতা, পোশাক কেনা বাবদ 'কিট অ্যালাউন্স' হিসেবে এবার শিক্ষার্থীরা ১ হাজার টাকা পেয়েছে। যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইনে জন্মনিবন্ধন আছে, তারা সবাই উপবৃত্তি পাচ্ছে। তবে বর্তমান বাজারদর হিসাবে মাসিক এ উপবৃত্তি ও কিট অ্যালাউন্স যৎসামান্য বলেও স্বীকার করেন তিনি। এ জন্য উপবৃত্তির টাকা বাড়াতে অভিভাবকরা তাঁর কাছে দাবিও জানিয়েছেন।

মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এইচএম মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, দাখিল মাদ্রাসাসহ উপজেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৮ হাজার ৯৭২ জন। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৮৯৬ জন উপবৃত্তি পায়। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রথম কিস্তিতে উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। উপবৃত্তি বাড়াতে সরকারের ওপর মহল থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোকসানা বেগম বলেন, যেভাবেই হোক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী রাখতে হবে। কোনো অজুহাতেই যেন তারা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে না যায়। বিদ্যালয়ে না এলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়বে। উপবৃত্তির টাকা বাড়াতে সংশ্নিষ্ট দপ্তরে অনুরোধ জানাবেন তিনি।