ঢলের তীব্রতা মোকাবিলা করা সাধারণ বন্যা মোকাবিলার চেয়ে অনেক কঠিন। ঢলের আঘাতে সম্পদ বাঁচানোর চিন্তা দুঃস্বপ্নের মতোই। জীবন রক্ষা করাই কঠিন। স্বাভাবিক বন্যার বিরুদ্ধে জানমাল রক্ষায় কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা গেলেও পাহাড়ি ঢলের বুনো আগ্রাসনের মুখে তা অসম্ভব। সেই আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ হতে পারে; শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় তার প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখেছে সুনামগঞ্জবাসী।

গত ১৬ জুন সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজারের লাখো মানুষ প্রলয়ঙ্করী এ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢলের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, ঘণ্টায় তখন দুই ফুট করে পানি বাড়তে থাকে গোটা অঞ্চলে।

১৭ জুন রাত পোহানোর আগেই ডুবে যায় জেলার ৮০ শতাংশের বেশি অঞ্চল। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়-চেরাপুঞ্জিতে ৬৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। সুনামগঞ্জে হয় ১৮৫ মিলিমিটার। অনেকে দোতলা অফিস, হাসপাতাল ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের তালা ভেঙে জীবন বাঁচিয়েছেন। অনেকের ঘর ভেসে গেছে। পরনের কাপড় ছাড়া তাদের কিছুই রক্ষা পায়নি। জীবিতদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আর মৃতদের কবর দেওয়ার মতো এক খ মাটিও ছিল না কোথাও।

১২২ বছরের ইতিহাসে কোনো জেলার ৮০-৯০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। এমন কঠিন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও ছিল না সীমান্তবর্তী এ জেলাবাসীর। দেখতে দেখতে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে যায়। জেলার কয়েক লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। সড়ক-রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ। জনজীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। হাটবাজার, দোকানপাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্য কেনার কোনো সুযোগই ছিল না। খাবার পানির সংকট ছিল চরম। এক কথায়, বেঁচে থাকার নূ্যনতম সুযোগও যেন এ অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল প্রকৃতি।

সরকারি হিসাবে এ বন্যায় জেলায় ১ হাজার ৭০০ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়। বেসরকারি হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে জেলায় পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ৬২টি। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭১ হাজার টাকার। দুর্দশাগ্রস্ত বানভাসি পরিবারের সংখ্যা ৪৫ হাজার নির্ধারণ করা হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। জেলার ২ হাজার ৮৮৮ গ্রামের মধ্যে দুই হাজার গ্রামই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ কৃষকের মধ্যে কমপক্ষে দুই লাখ কৃষকের গোলায় পানি লেগে যায়। কারও গোলার ওপরের অংশ পর্যন্ত পানি ছিল। ডুবে থাকা এসব পচা ধানে হাত বুলিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছে স্থানীয় বহু কৃষক।

সরকারি হিসাবে সুনামগঞ্জের ৬৮ হাজার কৃষকের গোলার ধান ভেসে যায়। এক হাজার ৬৪৭টি গবাদি পশু মারা যায়। এতে ক্ষতি হয় ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকার। হাঁস-মুরগি মারা যায় ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৪১টি। সবজিসহ নানা জাতের শস্যক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫ হাজার ৪৩২ হেক্টর এবং বীজতলা নষ্ট হয় ২৯ হেক্টর জমির। হ্যাচারি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ১৫৭টি।

তবে মানুষই যে মানুষকে রক্ষা করতে পারে- শতাব্দীর ভয়াবহ এ বন্যা মোকাবিলায় সে সত্য প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। বন্যা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুনামগঞ্জসহ সিলেটে বিভাগের বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের সহায়তায়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ বন্যাকবলিতদের সহায়তায় নিবেদিত ছিলেন।

জেলা দায়রা জজসহ বিচারালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিচার বিভাগের নির্মিত ভবনসহ তাঁদের বিভিন্ন ভবন বানভাসি মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। চারদিকে যখন হাহাকার, করুণ আর্তনাদ, বানভাসি মানুষ ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বলহারা মানুষের বেঁচে থাকার কাতর আকুতি; তখনই মানবিক মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে সহায়তা নিয়ে এসে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহস জুগিয়েছে অনেকেই।