ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ভোজবাজি’তে উধাও হকার-জ্যাম

‘ভোজবাজি’তে উধাও হকার-জ্যাম

হকারমুক্ত ফুটপাতে নির্বিঘ্নে পথচারী চলাচল। রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে মেহেদী হাসান সজীব

শরীফ উদ্দিন সবুজ, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:০৯

দশটি সড়ক এসে মিশেছে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায়। ঠিক মোড়ে একটি গোল চত্বর। চত্বরের মাঝখানে অবস্থিত বিজয়স্তম্ভ থেকে ৭০০ গজের কল্পিত বৃত্তে প্রতিদিন অন্তত ৩০০ হকার নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। এরই মধ্যে পড়বে পাঁচটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড। লেগুনা (হিউম্যান হলার) ও বাসস্ট্যান্ড আছে দুটি করে। মোটরসাইকেলের স্ট্যান্ডও একটি। দুটি বাসস্ট্যান্ডের একটি মৌমিতা পরিবহনের। এর অবস্থান শহীদ মিনারের ঠিক সামনে। বিপুল যানবাহনের চাপে সড়কে নামাই কঠিন। হকারের দাপটে ফুটপাতে হাঁটার ভোগান্তি নারায়ণগঞ্জবাসীর নিত্যদিনের। তবে গতকাল রোববার ভোজবাজির মতো হাওয়া সড়কের যানজট (জ্যাম)। উধাও ফুটপাতের সব হকার। 
শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয় গোলটেবিল বৈঠকের। সেখানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ও তাঁর ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। এরপর গতকাল নগরীর পুরো দৃশ্যপটই বদলে যায়।
মৌমিতা পরিবহনের বাস চাষাঢ়া থেকে ঢাকার গুলিস্তান-নিউমার্কেট হয়ে গাবতলী-সাভার পাড়ি দিয়ে নিয়মিত চলাচল করে চন্দ্রা পর্যন্ত। এ পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তাদের একটি বাসও রোববার সারাদিন ছিল না শহীদ মিনারের সামনে। ছিল না অন্য কোনো যানবাহনের অবৈধ স্ট্যান্ড। সিরাজউদ্দৌলা ও মীরজুমলা সড়কে আগের মতোই হকার বসতে দেখা গেলেও বঙ্গবন্ধু সড়ক ছিল হকারমুক্ত। বেলা ১১টা পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে কোনো বাসই চলাচল করেনি। তবে ফুটপাতে আবারও ব্যবসা করার দাবি নিয়ে এদিন দুপুরে হকার নেতারা যান শামীম ওসমানের কাছে। 
তবে ভিন্ন এ দৃশ্যের উল্টোপীঠে ছিল যাত্রী ভোগান্তি। সকালে নগরীর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারা পড়েন দুর্ভাবনায়। বন্ধন পরিবহন, উৎসব পরিবহনসহ সব পরিবহনের বাস ছিল বন্ধ। ঢাকার মতিঝিলের একটি করপোরেট অফিসের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল ৯টায় বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, কোনো বাস যাচ্ছে না। পরে ট্রেনে ঢাকায় যাই।’
চাষাঢ়ায় সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখায় কর্মরত ফরিদা পারভীনের সঙ্গে কথা হয় রোববার সকালে। তিনি বললেন, ‘আমি অফিসের সামনে এসে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলাম যে, আজ ছুটির দিন কিনা! চাষাঢ়া এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?’ সিএনজি স্ট্যান্ড ও হকারের ভিড় ঠেলে প্রতিদিন তাঁকে অফিসে যেতে হয়। কিন্তু গতকাল ভিন্ন চিত্র বিস্মিত করে ফরিদা পারভীনকে। 
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষাঢ়া ছাড়াও দুই নম্বর রেলগেট, ১ নম্বর রেলগেট, জিমখানা ও নিতাইগঞ্জ মোড়ে সড়কে কোনো অবৈধ স্ট্যান্ডে যানবাহন চোখে পড়েনি। হকার না থাকায় নির্বিঘ্নে মানুষ চলাচল করেছে। চাষাঢ়ার শহীদ মিনার, মহিলা কলেজ, রাইফেলস ক্লাব, সুগন্ধা বেকারি, খাজা মার্কেট, সোনালী ব্যাংক, দুই নম্বর রেলগেট, ১ নম্বর রেলগেট, জিমখানা ও নিতাইগঞ্জ মোড়, বাপ্পী চত্বরে পুলিশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। 
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে সকালে লেগুনা চলাচল বন্ধ ছিল। তবে পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের বৈঠকের পর বেলা সাড়ে ১১টার পর বাস ও লেগুনা চালু হয়। দেখা যায়, একটি করে লেগুনা এসে চাষাঢ়ায় থামছে। পরে যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ মোড়ের চিরাচরিত যানজট ছিল অদৃশ্য।
বন্ধন বাস মালিক সমিতির সভাপতি জুয়েল হোসেনের ভাষ্য, জেলা প্রশাসন বৈধ কাগজহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে– এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়লে মালিকরা আতঙ্কে বাস বন্ধ রেখেছিলেন। পরে জেলা প্রশাসক জানতে পারেন, তাদের ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে, ট্যাক্স টোকেন আছে; কিন্তু সরকারি নিয়ম-কানুনের জটিলতায় সব বাসের রুট পারমিটের কাগজ নেই। তারা রুট পারমিটের আবেদন করেছেন জানালে জেলা প্রশাসক তা ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে বাস চালানো শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু সড়কে কোনো হকার বসতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) রুহুল আমিন সাগর বলেন, অবৈধ স্ট্যান্ডে যাতে কোনো যানবাহন না দাঁড়ায় সে ব্যাপারে তৎপর রয়েছেন। এটা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ।
এদিকে প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে দুর্ভোগে পড়েন হকাররা। তাদের আমীর মুন্সী গতকাল রাতে বলেন, ‘হকারি করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকি। হয়তো আমরা অবৈধভাবে বসি, কিন্তু আমাদের ব্যবসা তো অবৈধ না। আমরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে হকারি করে টিকে থাকি।’ সারাদিন না হোক দিনের একটি অংশে হলেও বসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আমীর মুন্সী বলেন, পরিবার-পরিজনের আয়ের ব্যবস্থা না থাকলে হকারদের ছেলেমেয়েরা বিপথে যাবে। 
দুপুরে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান নগরীর কালিরবাজারে নারায়ণগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়ক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। সেখান থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হকাররা তাঁকে ঘিরে ধরে কোথাও ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। তবে কোনো সুস্পষ্ট আশ্বাস শামীম ওসমান দেননি। তিনি সেখানে বলেন, হকার উঠালে সব হকার উঠাতে হবে। না উঠালে কাউকে উঠানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘তারপরও আমার এলাকার হকারদের একটা ব্যবস্থা করব।’

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×