আমবাগান কেটে পুকুর খনন
রাজশাহীর চারঘাটে আমের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা ও লোকসানের কারণে অনেকে বাগান কেটে ফেলছেন সমকাল
সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২২:৫০
চারঘাটের বড়বড়িয়া গ্রামের মুক্তার হোসেনের চার বিঘা জমিতে ছিল আমবাগান। লোকসান হওয়ায় সব গাছ কেটে বছরে ২০ হাজার টাকায় মাছ চাষিকে বর্গা দিয়েছিলেন তিনি। তবে নিষেধ থাকায় পুকুর খনন করতে পারেননি তিনি। বাধ্য হয়ে সবজি চাষ করছেন। মুক্তার বলছিলেন, ‘সুযোগ পেলে পুকুর খনন করব। মাছের বাজারদর বেশি। নগদ টাকা পাওয়া যায়। দুই বছর আগের আম বিক্রির আগের টাকা এখনও বাকি পড়ে আছে।’
মুক্তারের কৃষিজমি অক্ষত থাকলেও অনুপামপুর গ্রামের আইনাল হকের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। তিনি চৌধুরীর বিল এলাকার পাঁচ বিঘা বাগান কেটে গত বছর পুকুর খনন শুরু করেন। তবে উপজেলা প্রশাসন খনন বন্ধ করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল। তিনি এ বছর খনন শেষ করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আম বিক্রি করে সারাবছরের খাবার হয় না। অনেকে পুকুর খনন করেছে। বাধ্য হয়ে আমিও করেছি। মাছ চাষ করছি, চুরি তো করছি না।’
আমের জন্য সুপরিচিত রাজশাহীর চারঘাটে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা ও লোকসানের কারণে মুক্তার ও আইনালের মতো অনেকে বাগান কেটে ফেলছেন। তারা ঝুঁকছেন মাছ ও সবজি চাষে। সরকারি নিষেধ অমান্য করে অনেকে রাতে পুকুর খনন করছেন। কৃষি
বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে ৫০ হেক্টর বাগান কেটে ফেলা হয়েছে। গত বছর আম বাগান ছিল ৪ হাজার ৯৫৩ হেক্টর। এবার কমে হয়েছে ৪ হাজার ৯০৩ হেক্টর।
এদিকে মৎস্য বিভাগ জানায়, উপজেলায় পুকুর বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৭৫৫টি। দুই বছর আগে ছিল ৩ হাজার ৫১৫টি। দুই বছরে বেড়েছে ২৪০টি। উপজেলায় বছরে মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৫ হাজার ৬০০ টন। দুই বছর আগে ছিল ৫ হাজার ২০০ টন। ৪০০ টন উৎপাদন বেড়েছে।
কৃষির পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা কয়েকটি সংস্থা বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের এমন পরিবর্তন আরও ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে। তাদের যুক্তি, আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা দেশে গড়ে ওঠেনি। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হলে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দাম কমলে ক্ষতি পোষাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
খরচ বাড়লেও দাম না থাকায় বাগানগুলো এখন গলার কাঁটা বলে দাবি অনেক কৃষকের। তারা জানান, উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা বাড়েনি। অন্য জেলায় ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রি করে। চারঘাটেও একই পদ্ধতিতে বিক্রি করে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী পাঁচ বছর ধরে লোকসান গুনছেন। এলাকার ৫০ শতাংশ মানুষ আমের ওপর নির্ভরশীল হলেও দুর্যোগ ও মহামারির পাশাপাশি নওগাঁসহ কিছু অঞ্চলে ব্যাপক চাষের কারণে দাম পাচ্ছেন না।
উপজেলার পরানপুর, অনুপামপুর, ভায়ালক্ষ্মীপুর ও রায়পুর ঘুরে বাগান কেটে পুকুর খননের প্রমাণ মিলেছে। সবজি চাষও চলছে। অনেকে অসময়ের ফল ও হাইব্রিড আম চাষ শুরু করেছেন। রাওথা এলাকার রবিউল ইসলাম বলেন, সার ও কীটনাশক না দিলে আম আসে না। এগুলোর দাম বাড়ছে। কিন্তু আমের দাম বাড়ে না। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হওয়ার ভয়ে লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগ নেই। বাধ্য হয়ে তিনি ছয় বিঘা বাগানের অর্ধেক কেটে মাছ ও সবজি চাষ করছেন।
পরানপুরের শরীফুল ইসলামের ভাষ্য, সাত বিঘা বাগান থেকে বছরে লাখ টাকা আসত। খরচ বাদে অর্ধেক টাকা ঘরে তুলতে পারতেন। অনেক সময় লোকসানও হতো। এখন খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে। এতে সংসার চলছে না। ফলে ৯৫টি গাছ কেটে ফেলেছেন।
বাগান কেটে ফেলায় এলাকার সুনাম হারাতে বসেছে জানিয়ে উপজেলা আমচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হামিদুর সরকার বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমচাষ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পরিবহন খরচ কমানোর পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে শিল্প উদ্যোক্তাদের। না হলে আমবাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমগাছ ৩০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন দেয়। এর পর কমতে থাকে। চারঘাটের অধিকাংশ গাছ পুরোনো হওয়ায় ফলন কমছে। এ ছাড়া লকনা আমের চাষ বেশি। এগুলো কম মিষ্টি হওয়ায় দাম কমবেশি হয়। এ জন্য চাষিরা হয়তো কিছুটা বিমুখ হচ্ছেন। নতুন জাত এবং সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে আমচাষে লাভবান হওয়া সম্ভব।
বাগান কাটার কথা স্বীকার করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা খন্দকার ফিরোজ মাহমুদ বলেন, অনেকে পরিকল্পিতভাবে নতুন জাতের আমবাগান করছেন। পুকুর খনন না করতে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।