সীমানুরের প্রতি স্বামীর সীমাহীন ভালোবাসা

বগুড়ায় ভালোবাসার অনন্য নজির গড়া সীমানুর- ফেরদৌস দম্পতি সমকাল
আব্দুল আউয়াল, বগুড়া
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২২:৫৪ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১২:০৩
স্বামীর মতো স্ত্রীও চাকরি বা ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করবেন– এ বিষয়টি আমাদের সমাজের অনেকে এখনও সহজভাবে নেন না। এমনকি স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনাও অনেক ঘটছে। তবে ব্যতিক্রম বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বাঘবাড়ি গ্রামের রিকশাচালক ফেরদৌস।
ছোটবেলা থেকে ফেরদৌসের ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার। দারিদ্র্যের কারণে নবম শ্রেণি পাসের পরই সংসারের হাল ধরতে রিকশার প্যাডেল মারতে শুরু করেন।
পারিবারিকভাবে ২০০৯ সালে ফেরদৌসের সঙ্গে পাশের ধুনট উপজেলার সীমানুর খাতুনের বিয়ে হয়। সে সময় সীমানুর ছিলেন এসএসসি পাস। নিজে যা পারেননি, তা স্ত্রীকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছেন ফেরদৌস। কষ্টার্জিত আয় দিয়ে শুধু সংসারই চালাননি, স্ত্রীকে করেছেন সুশিক্ষিত।
স্বামীর রিকশাতেই সীমানুর যাতায়াত করতেন কলেজে। সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য পড়ালেখার ফাঁকে দর্জির কাজ করেছেন। ধুনট কলেজ থেকে বিএ পাসের পর মাস্টার্স করতে ভর্তি হন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী সরকারি আজিজুল হক কলেজে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন সীমানুর।
ফেরদৌস ও তাঁর স্ত্রীর জীবন সংগ্রাম নিয়ে একটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। প্রধানমন্ত্রী চাকরির ব্যবস্থা করেন। গত ১৫ জানুয়ারি সীমানুরের হাতে স্কুলশিক্ষকের নিয়োগপত্র তুলে দেন বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাথমিক শাখার সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
গাবতলীর বাঘবাড়িতে আধাপাকা ঘরে থাকেন এই দম্পতি। অনেক সংগ্রামের পর স্ত্রীকে স্বপ্নের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন ফেরদৌস। স্বপ্ন পূরণের এ বছরই প্রথম পেলেন বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস। সীমানুর জানালেন, এমন দিনে তাঁর সব খুনসুটি হবে ফেরদৌসকে ঘিরে।
স্ত্রীর সাফল্যে আনন্দের সীমা নেই ফেরদৌসের। তিনি বললেন, নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি। বিয়ের পর দেখলেন স্ত্রীর এসএসসিতে ফলাফল ভালো। তাই সিদ্ধান্ত নেন, যত কষ্টই হোক তাঁকে পড়াশোনা করাবেন। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আজিজুল হক কলেজের শিক্ষকদের প্রতি।
তবে এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। সমাজের অনেক কটুকথা শুনেই এগিয়ে যেতে হয়েছে। ফেরদৌস বলেন, তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষিত করার। তাই কখনো কটুকথায় পাত্তা দেননি।
স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে ও মাকে নিয়ে ফেরদৌসের সংসার। মেয়ে আরিফা খাতুন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে সাবির বিন তাসনিমের বয়স তিন বছর। সীমানুরের স্বপ্ন পূরণে স্বামীর পাশাপাশি শাশুড়ির সমর্থনও ছিল জোরালো। শাশুড়ি খুকী বেওয়া বলেন, ‘বিয়ের পরেই ছেলে সিদ্ধান্ত নেয় বউকে লেখাপড়া করাবে। তার সিদ্ধান্তে কখনও দ্বিমত করিনি। আমাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে।’
ভালোবাসার সংজ্ঞাটা কেমন জানাতে গিয়ে ফেরদৌস বললেন, ‘মানুষ কী বলেছে, সেটা না ভেবে নিজের বিবেকে স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস রেখে লেখাপড়া করিয়েছি– এটাই আমার ভালোবাসা।’
স্বামীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সীমানুর বলেন, ‘আমার স্বামী আমার জন্য যা করেছে, তার প্রতিদান দেওয়াই এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।’
সীমানুর খুবই নিবিড়ভাবে শিক্ষার্থীদের যত্ন নেন ও পাঠদান করেন জানিয়ে কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আল মামুন সরদার বলেন, তাঁর (সীমানুর) স্বামীর পরিশ্রম ও স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা সত্যিই অনুকরণীয়।