ইলিশের ট্রলার বদলে হচ্ছে নিষিদ্ধ ট্রলিং নৌযান

.
সুমন চৌধুরী, বরিশাল ও ইমাম হোসেন নাহিদ পাথরঘাটা (বরগুনা)
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০:২৭
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য মোকাম বরগুনার পাথরঘাটা। মৎস্য আহরণে এ মোকামে সমুদ্রগামী ট্রলার রয়েছে ২১০টি, যার সবই কাঠবডির। এই মোকামে ব্যবসা করা মাসুম কোম্পানির একটি ট্রলার দুই বছর আগে স্থানীয় পদ্ধতিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযান বা ট্রলিং জাহাজে রূপান্তর করা হয়। দেখা যায়, এতে ট্রলারটিতে মাছ আহরণ করা যাচ্ছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ফলে গত দুই বছরে মাসুম কোম্পানির আরও দুটিসহ বিভিন্ন মালিক এ পর্যন্ত ৩২টি কাঠবডির ট্রলারকে ট্রলিং নৌযানে রূপান্তর করেছেন। অথচ কাঠের ট্রলারকে ট্রলিং নৌযানে রূপান্তর করা সরকারিভাবে নিষেধ।
জানা গেছে, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে ট্রলিং নৌযান ব্যবহার করতে হলে তা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করতে হয়। আবার সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরে এই নৌযান নিবন্ধিত হওয়াও বাধ্যতামূলক। কারণ, এসব নৌযানে সাগরে জাল ফেলা ও তোলা সবকিছু যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক ডিভাইস। এ নৌযান নিবন্ধনের প্রধান শর্ত, মাছ আহরণের জন্য সাগরের ৪০ মিটারের বেশি গভীর পানিতে জাল ফেলতে হবে। কিন্তু বর্তমানে কাঠবডির ট্রলারে স্থানীয় পদ্ধতিতে ট্রলিং নৌযানের যন্ত্র স্থাপন করে মাছ আহরণ করছেন কিছু ব্যবসায়ী। এই রূপান্তরে প্রতিটি ট্রলারে ব্যয় হচ্ছে ৩০-৩৫ লাখ টাকা। ট্রলারগুলো সাগরের মাত্র ছয়-সাত মিটার গভীর পানিতেই যন্ত্র দিয়ে জাল টেনে মাছ ধরছে।
শুধু পাথরঘাটা নয়, উপকূলীয় মোকাম পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর-আলীপুর এবং ভোলা মিলিয়ে বর্তমানে ট্রলিং নৌযানের সংখ্যা শতাধিক হবে। এসব ট্রলার সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাথরঘাটার মৎস্য ব্যবসায়ী জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সাগরে মাছের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ট্রলিং সব শেষ করে দিচ্ছে। প্রশাসনের চোখের সামনে আইনবহির্ভূত এ কাজটি হলেও কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
অভিযোগ রয়েছে, মাছ আহরণে অবৈধ ট্রলিং নৌযান ব্যবহার চলছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। এজন্য প্রতিটি নৌযান থেকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। নৌযানের মালিক জেলা পরিষদ সদস্য এনামুল হোসাইন টাকা ওঠানোর দায়িত্ব পালন করছেন। পাথরঘাটায় ট্রলিং যন্ত্র স্থাপন করা প্রথম ট্রলার মালিক মাসুম কোম্পানির মো. মাসুম মিয়া বলেন, ‘ট্রলিং নৌযান অনেক বড় ব্যাপার। আমিসহ কয়েকজন মালিক সাগরে জাল ফেলা ও তোলার জন্য ট্রলারে ড্রাম এবং কিছু প্রযুক্তি স্থাপন করেছি। এতেই আমাদের ট্রলারগুলো ট্রলিং নৌযান হয়ে যায়নি। সাগরে মাছ কম, তাই শ্রমিক কমানোর জন্য এ কাজটি আমরা করেছি। আগে একটি ট্রলারে ২৫ জন শ্রমিক লাগত, এখন ১০ জন হলেই চলে।’ মাসুম মিয়ার দাবি, ট্রলারে এসব সামান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে কোনো দপ্তরের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কম গভীরে জাল ফেলার অভিযোগও অস্বীকার করে তিনি বলেন, ৮-১০ মিটার গভীরে মাছ পাওয়া যায় না। আমরা ৪০ মিটারের বেশি গভীর পানিতে জাল ফেলি।’
মাসুম মিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীর মহিপুরে ১৩টি, ভোলায় ৮৬টি এবং ভোলার লালমোহন উপজেলার গজারিয়া মোকামে ১৭টি ট্রলারে এ রকম প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। পাথরঘাটায় এ রকম ট্রলার রয়েছে ১৭-১৮টি।
অবৈধ ট্রলিং নৌযানের আরেক মালিক বরগুনা জেলা পরিষদ সদস্য এনামুল হোসাইনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, ‘বৈধ ট্রলিং নৌযানও সাগরের কম গভীর এলাকায় এসে মাছ ধরছে। ভারতের হাজার হাজার ট্রলিং নৌযান মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আপনারা সেগুলো দেখেন না।’ প্রশাসন ম্যানেজের নামে ট্রলারপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে নেওয়ার কথাও অস্বীকার করেন তিনি।
এভাবে অবাধ মাছ আহরণে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মার্কেটিং অফিসার বিপ্লব কুমার। তিনি কয়েক বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধীনে উপকূলে মৎস্য গবেষণায় ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। বিপ্লব বলেন, ‘সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত ট্রলিং নৌযানকে কমপক্ষে ৪০ মিটার গভীর গিয়ে জাল ফেলার শর্ত দেওয়া হয়। এতে জালের নিচের অংশ থেকে সাগরের তলদেশ আরও গভীরে থাকে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ট্রলার থেকে রূপান্তরিত ট্রলিং নৌযানগুলোর জাল সাগরের আট মিটারের বেশি গভীরে যায় না। অথচ সাগরের এই স্তরে মাছের রেণু ও ডিম থাকে। ফলে ট্রলিং নৌযানের ফেলা বাঁধা জালে মাছের সঙ্গে রেণু ও ডিম উঠে আসে। এভাবে আহরণে শুধু মাছের প্রজননই বিনাশ হচ্ছে না, ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে সাগর তলদেশের জীববৈচিত্র্য। মাছের বৈশিষ্ট্য হলো, খাদ্য সংকটে পড়লে তারা গতি পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যায়। খাদ্য সংকটের কারণে পাথরঘাটা উপকূলে টুনা মাছ আগের চেয়ে কমেছে।’
একই মত দেন পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জিব কুমার। তিনি বলেন, অনেক সময় বৈধ ট্রলিং নৌযানও নিবন্ধনের শর্ত ভেঙে ৮-১০ মিটার গভীরতায় এসে মাছ আহরণ করছে। অবৈধ ট্রলিং নৌযানগুলো কেন জব্দ করা হয় না– জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, মৎস্য আইনে যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে। অবৈধদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা উল্টো আমাদের আইনের ফাঁদে ফেলে।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, অবৈধ ট্রলিং নৌযান বন্ধে জেলা ও প্রতিটি উপজেলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
ট্রলার শ্রমিক সমিতির সভাপতি মান্নান মাঝি বলেন, অবৈধ ট্রলিং নৌযানে আমাদের সমিতির সদস্যরাই কাজ করেন। তাই এটি বন্ধে তারা প্রকাশ্যে আন্দোলনে যেতে পারছেন না।
সার্বিক বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, ‘উপকূলে ট্রলারে অবৈধভাবে প্রযুক্তি স্থাপন করে ট্রলিংয়ের মাধ্যমে মাছ আহরণের বিষয়টি তারা অবগত। এসব অবৈধ নৌযানের তালিকা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো গভীর সাগরে থাকায় জব্দ করা যাচ্ছে না।’ আহরিত মাছ নিয়ে মোকামে আসার পর কেন জব্দ হয় না– জানতে চাইলে উপপরিচালক বলেন, এগুলো আমাদের অগোচরে মোকামে আসে।
অভিযোগ আছে, সাগরে অবৈধ মাছ ধরা বন্ধে মৎস অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের পাথরঘাটা এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাকিব মেহেবুব বলেন, অবৈধ নৌযান জব্দের দায়িত্ব অধিদপ্তরের। আমরা সহযোগিতা করতে পারি যদি তারা আমাদের ডাকে। তবে এখন পর্যন্ত অধিদপ্তর এ বিষয়ে আমাদের ডাকেনি। ডাকলে আমরা সহযোগিতা করব।